
Kalyani University Suggestion
Kalyani University B.A 4th Semester Political Science Major 5 Suggestions 2025
Understanding International Relations: Theories and Concepts
Kalyani University B.A 4th Semester Political Science Major 5 ছোট প্রশ্ন, বড়ো প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন PDF টি পেতে.. আপনি 150 টাকা পেমেন্ট করুন। পেমেন্টের পর এক সেকেন্ডের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাজেশনটি পাবেন। ধন্যবাদ। টাকা টি পেমেন্ট করার জন্য নিচে PAY বাটনে ক্লিক করুন।
অথবা আপনি চাইলে সরাসরি PhonePe-এর মাধ্যমে 99 টাকা পেমেন্ট করে সাজেশন সংগ্রহ করতে পারেন। PhonePe নম্বর: 6295668424 (পেমেন্টের পর স্ক্রিনশট হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালে PDF COPY পাঠিয়ে দেব।)
My Phone Number- 6295668424
• এই সাজেশনের বড়ো প্রশ্ন সংখ্যা 28 টি।
ছোট প্রশ্ন প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন পাবেন।
• নিরক্ষরেখে বলতে পারি এই সাজেশনেরর বাইরে কোন প্রশ্ন উত্তর আসবে না।
• ১০০% তোমরা কমন পাবে।
• এই সাজেশনের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সিলেবাস অনুযায়ী এবং ইউনিট
অনুযায়ী সাজানো রয়েছে ।
• তোমরা চাইলে খুব সহজে BUY করতে পারো।
• THANK YOU.
এখানে অল্প কিছু প্রশ্নোত্তর আপলোড করা হয়েছে যদি তোমার মনে হয় সাজেশনটি BUY করতে পারো ।
(সিলেবাস – ২০২৫)
Unit 1:
বাংলা: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: শিক্ষাগত শৃঙ্খলা হিসেবে এর বিকাশের রূপরেখা — আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্ব কী?
English: International Relations: Outline of its evolution as an academic discipline – What is International Relations Theory?
Unit 2:
বাংলা: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শৃঙ্খলায় প্রধান বিতর্কসমূহ — প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মহাবিতর্ক।
English: The Great Debates in the discipline of International Relations: First, Second and Third.
Unit 3:
বাংলা: মূলধারার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বসমূহ:
(ক) ধ্রুপদী বাস্তববাদ ও নব্য বাস্তববাদ
(খ) উদারবাদ ও নব্য উদারবাদ
(গ) মার্কসবাদী তত্ত্ব — নির্ভরতা তত্ত্ব ও বিশ্ব ব্যবস্থা তত্ত্ব
(ঘ) নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি
(ঙ) ইউরোকেন্দ্রিকতা ও গ্লোবাল সাউথ-এর দৃষ্টিভঙ্গি
English: Mainstream International Relations Theories: Classical Realism and Neo-Realism, Liberalism and Neo-Liberalism, Marxian – Dependency & World Systems Theory, Feminist Approach, Eurocentrism and Perspectives from the Global South.
Unit 4:
বাংলা: জাতীয় শক্তি — সংজ্ঞা, উপাদান ও সীমাবদ্ধতা; শক্তি-সাম্য রক্ষা করার উপায়সমূহ; সম্মিলিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
English: National Power: Definition, Elements and Limitations – Balance of Power – Devices of maintaining Balance of Power – Collective Security.
Unit 5:
বাংলা: পররাষ্ট্রনীতি — লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য; পররাষ্ট্রনীতির উপকরণসমূহ: কূটনীতি, প্রচার ও বৈদেশিক সাহায্য।
English: Foreign Policy – Objectives – Instruments of Foreign Policy: Diplomacy, Propaganda and Foreign Aid.
এখানে কয়েকটি প্রশ্নোত্তর উদাহরণ হিসেবে দেওয়া হল। সম্পূর্ণ সাজেশন PDF কপি খুব সহজে BUY করতে পারো।
UNIT-1 আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
*****1) প্রশ্ন. তুমি কি মনে করো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র বিষয়? উত্তরের পক্ষে যুক্তি দাও। (৫)
ভূমিকা:
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (International Relations বা সংক্ষেপে IR) আধুনিক যুগে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্লেষণাত্মক শিক্ষাক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো যতই একে অপরের সঙ্গে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সংযুক্ত হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ততই একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে। এই বিষয়ে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সংযোগ, যুদ্ধ-বিরোধ, অর্থনৈতিক বিনিময়, আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশ্ব রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করা হয়।
আমার মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অবশ্যই একটি স্বতন্ত্র বিষয় এবং নিচের যুক্তিগুলির মাধ্যমে তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো।
১. স্বতন্ত্রতাবোধের ঐতিহাসিক বিকাশ: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র বিষয়ের রূপ পেয়েছে ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, যখন ‘উইলসনের চৌদ্দ দফা’ (Fourteen Points) এবং ‘লীগ অব নেশনস’-এর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক গঠনের গুরুত্ব উপলব্ধি করা হয়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটি স্বতন্ত্র বিষয়ের আকারে পড়ানো শুরু হয়। এটি স্পষ্ট করে যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্মই হয়েছে স্বতন্ত্র চর্চা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন থেকে।
২. নিজস্ব তাত্ত্বিক কাঠামো: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রয়েছে নিজস্ব তাত্ত্বিক কাঠামো — যেমন বাস্তববাদ (Realism), উদারবাদ (Liberalism), নব্য-বাস্তববাদ, গঠনবাদ (Constructivism) ইত্যাদি। এই তত্ত্বগুলো আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে, যেমন কেন যুদ্ধ হয়, কেন কিছু রাষ্ট্র সহযোগিতা করে আবার কিছু রাষ্ট্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এই তত্ত্বগুলো অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয় থেকে ভিন্ন, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
৩. গবেষণার নিজস্ব ক্ষেত্র:
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রয়েছে বিশাল ও স্বতন্ত্র গবেষণার ক্ষেত্র। যেমন:
• যুদ্ধ ও শান্তি গবেষণা (War and Peace Studies)
• কূটনীতি ও বিদেশনীতি (Diplomacy and Foreign Policy)
• আন্তর্জাতিক সংস্থা (UNO, WTO, IMF ইত্যাদি) বিশ্লেষণ
• বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা ইস্যু (Global Security Issues)
• আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং আইনের প্রয়োগ
• পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন ইত্যাদি।
এসব গবেষণার ক্ষেত্র প্রমাণ করে যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চর্চা সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা ইতিহাসের উপবিষয় না হয়ে নিজেই একটি পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ শাখা।
৪. আন্তঃবিষয়কতা থাকা সত্ত্বেও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অবশ্যই অন্যান্য শাস্ত্র যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদির সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত, তবে সেটি এই বিষয়টিকে আর অধিক শক্তিশালী করেছে। এটি একধরনের interdisciplinary field, কিন্তু এর নিজস্ব প্রশ্ন, বিশ্লেষণ পদ্ধতি এবং উদ্দেশ্য থাকার কারণে এটি নিজেকে স্বতন্ত্র বিষয়ে পরিণত করতে পেরেছে। যেমন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করে, কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রাষ্ট্রের বাইরের সম্পর্কের বিশ্লেষণ করে — এটি একটি মৌলিক পার্থক্য।
৫. আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা: আধুনিক বিশ্বে বিশ্বায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যুদ্ধ, মাইগ্রেশন, প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য। এই বিষয়গুলো স্থানীয় বা জাতীয় নীতির মাধ্যমে বোঝা যায় না। একমাত্র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়টির বিশ্লেষণ ও সমাধানের পথ নির্দেশ করতে পারে। তাই এটি সময়োপযোগী এবং বাস্তবধর্মী শিক্ষাক্ষেত্র হিসেবেও স্বতন্ত্র।
৬. পেশাগত ক্ষেত্র ও ব্যবহারিক প্রয়োগ: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পড়াশোনা করে শিক্ষার্থীরা জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক এনজিও, কূটনৈতিক পরিষেবা, আন্তর্জাতিক ব্যবসা সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইত্যাদি বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হতে পারে। এ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা কূটনৈতিক মিশনে কাজ করতে হলে এই বিষয়ে জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরি। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে এই বিষয়ের রয়েছে বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্যতা এবং পেশাগত স্বাতন্ত্র্য।
৭. নীতি প্রণয়ন ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের জন্য প্রাসঙ্গিকতা: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মাধ্যমে এক দেশের পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে প্রণয়ন হয়, কীভাবে আন্তর্জাতিক কূটনীতি পরিচালনা করা হয়, কোন রাষ্ট্র কাদের সঙ্গে জোট বাঁধবে — এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যয়ন অপরিহার্য। এ ধরনের বিশ্লেষণ ক্ষমতা অন্য কোনো বিষয়ের পঠনপাঠন থেকে অর্জন করা যায় না।
৮. আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের গুরুত্ব: বিশ্বে ঘটে যাওয়া যুদ্ধ, গণহত্যা, উদ্বাস্তু সমস্যা, শিশুশ্রম, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি মানবিক ইস্যু আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনা ও সমাধানের দাবি রাখে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়টি এই সকল সমস্যাকে ন্যায়বিচার, নীতিমালা এবং বহুপাক্ষিক চুক্তির আলোকে ব্যাখ্যা করে এবং সমাধানসূত্র প্রদান করে।
৯. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগে আরও প্রাসঙ্গিক: বর্তমানে রাষ্ট্রীয় সীমা প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেকটাই অদৃশ্য। ডিজিটাল অর্থনীতি, সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল কূটনীতি ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। অতএব, এই নতুন বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য আরও বেড়েছে।
১০. শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিততা: বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি পূর্ণাঙ্গ অনার্স, মাস্টার্স ও গবেষণা স্তরের বিষয় হিসেবে পড়ানো হয়। ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (JNU), দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে এটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে পরিচিত। এর মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্বীকৃতি ও গুরুত্ব স্পষ্ট।
উপসংহার:
উপরে উল্লিখিত যুক্তিগুলির আলোকে বলা যায় যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি পূর্ণাঙ্গ, বিশ্লেষণমুখী, এবং বহুমাত্রিক শিক্ষাবিষয়। এটি শুধুমাত্র রাষ্ট্রের বাহ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে না, বরং বৈশ্বিক শান্তি, নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। আজকের বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ছাড়া কোনও রাষ্ট্রের যথাযথ পরিচালনা বা উন্নয়ন সম্ভব নয়।
তাই, আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র বিষয়, যার রয়েছে নিজস্ব চর্চার ক্ষেত্র, তত্ত্ব, বিশ্লেষণ পদ্ধতি এবং বাস্তব প্রয়োগ। এই বিষয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতের বৈশ্বিক নেতৃত্ব গঠনে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
UNIT-2 আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শৃঙ্খলার মহাবিতর্ক
*****2) প্রশ্ন. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ‘প্রথম মহাবিতর্ক’ সম্পর্কে একটি মূল্যায়ন করো। (১০)
ভূমিকা:
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (International Relations বা IR) হলো একটি স্বতন্ত্র এবং বিশ্লেষণভিত্তিক বিদ্যাশাখা, যা রাষ্ট্রসমূহ, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ব রাজনীতির মধ্যে কার্যকারিতা, শক্তি, স্বার্থ, কূটনীতি ও সংঘাতের মতো বিষয় বিশ্লেষণ করে। এই বিদ্যার বিকাশে বিভিন্ন ধরণের তাত্ত্বিক বিতর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই বিতর্কগুলিকে সাধারণত "মহাবিতর্ক" (Great Debates) হিসেবে অভিহিত করা হয়। এর মধ্যে ‘প্রথম মহাবিতর্ক’ (First Great Debate) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক। এটি মূলত আদর্শবাদ (Idealism) বনাম বাস্তববাদ (Realism) তত্ত্বের মধ্যে সংঘটিত হয়।
প্রথম মহাবিতর্কের পটভূমি:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৯১৮) ছিল মানবজাতির ইতিহাসে এক চরম ধ্বংসাত্মক অধ্যায়, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রশ্নে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিল। যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে একদল চিন্তাবিদ ও নীতিনির্ধারক বিশ্বাস করতেন, যুদ্ধ রোধ করা সম্ভব এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও নৈতিক নীতিমালার মাধ্যমে এক শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলা যায়। এই চিন্তাধারার ভিত্তিতেই আদর্শবাদী বা উদারনৈতিক (Idealist/Liberal) দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।
এই সময় আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটি স্বতন্ত্র বিদ্যাশাখা হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয়। ১৯১৯ সালে ওয়েলসের অ্যাবেরিস্টউইথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর অধ্যয়ন শুরু হয়।
আদর্শবাদের দৃষ্টিভঙ্গি:
- মানব প্রকৃতি মৌলিকভাবে ভালো: মানুষের মধ্যে সহানুভূতি ও সহাবস্থানের স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে।
- আন্তর্জাতিক আইন ও প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ: জাতিসংঘ, লীগ অব নেশনস, আন্তর্জাতিক আদালত ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংঘাত প্রতিরোধ করা সম্ভব।
- নৈতিক মূল্যবোধ প্রাধান্য পায়: রাষ্ট্রগুলো কেবল জাতীয় স্বার্থ নয়, বরং নৈতিক দায়িত্বের ভিত্তিতেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।
- শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব: শিক্ষার প্রসার, গণতন্ত্রের বিকাশ এবং অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতার মাধ্যমে যুদ্ধ প্রতিরোধ করা যায়।
আদর্শবাদীদের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson), যিনি “Fourteen Points” নামে একটি পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন, যাতে আন্তর্জাতিক শান্তি বজায় রাখার রূপরেখা প্রদান করা হয়।
বাস্তববাদের উত্থান:
তবে ১৯৩০-এর দশকে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা তীব্রতর হয় এবং অবশেষে ১৯৩৯ সালে বিশ্ব আবারও যুদ্ধের মুখোমুখি হয়, তখন আদর্শবাদী নীতিমালার কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে বাস্তববাদী (Realist) চিন্তাধারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বে প্রাধান্য লাভ করে।
- রাষ্ট্রই মূল অভিনেতা: আন্তর্জাতিক রাজনীতি মূলত রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো নিজেকে টিকিয়ে রাখা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
- আত্মস্বার্থ ও শক্তির রাজনীতি প্রাধান্য পায়: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি ‘শূন্য-যোগ গেম’, যেখানে এক রাষ্ট্রের লাভ মানে অন্য রাষ্ট্রের ক্ষতি।
- আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা অরাজক: কোনো কেন্দ্রীয় সরকার না থাকায় ‘আন্তর্জাতিক অরাজকতা’ বিরাজ করে।
- নৈতিকতার ভূমিকা সীমিত: রাষ্ট্রগুলো বাস্তব পরিস্থিতিতে নৈতিকতা নয়, বরং কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
বাস্তববাদের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন হ্যান্স জে. মরগেথাউ, যিনি তাঁর গ্রন্থ Politics Among Nations (১৯৪৮)-এ বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেন।
বিতর্কের মূল উপাদান:
- আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রকৃতি কী? নৈতিক না স্বার্থভিত্তিক?
- মানব প্রকৃতি মৌলিকভাবে ভালো না খারাপ?
- যুদ্ধ কি প্রতিরোধযোগ্য? নাকি যুদ্ধ অনিবার্য?
- আন্তর্জাতিক আইন ও প্রতিষ্ঠান কতটা কার্যকর?
- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণযোগ্য?
মহাবিতর্কের তাৎপর্য:
- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন: আদর্শবাদ ও বাস্তববাদের দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
- ভবিষ্যৎ বিতর্কের পথপ্রদর্শক: এটি পরবর্তী মহাবিতর্কগুলোর সূচনা করে।
- বিশ্লেষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি: শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের দক্ষতা বাড়ায়।
সমালোচনা:
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আদর্শবাদ ও বাস্তববাদ একে অপরের বিরুদ্ধে সরাসরি তর্ক করেনি বরং সময় ও বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আলাদা আলাদা সময়ে বিকশিত হয়েছে। তাছাড়া, এই বিতর্ক মূলত পশ্চিমা বিশ্বের অভিজ্ঞতাভিত্তিক, যা বৈশ্বিক বাস্তবতাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে না।
উপসংহার:
‘প্রথম মহাবিতর্ক’ আন্তর্জাতিক রাজনীতির মৌলিক বোঝাপড়ার ভিত্তি স্থাপন করে। আদর্শবাদ ও বাস্তববাদের সংঘাত শুধু একাডেমিক নয়, বরং বাস্তব বিশ্বের প্রতিফলন। বর্তমান বিশ্বে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা, মানবিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলায় এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় প্রয়োজন। তাই, এই বিতর্ক কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।
Unit 3- মূলধারার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বসমূহ
*****3) প্রশ্ন. আন্তর্জাতিক সম্পর্কে উদারনৈতিক তত্ত্ব (লিবারেল থিওরি)-এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো। (৫)
ভূমিকা: আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক চর্চায় উদারনৈতিক তত্ত্ব একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী চিন্তাধারা হিসেবে বিবেচিত হয়। লিবারেলিজম বা উদারনীতিবাদ মূলত ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর জোর দেয়। এই তত্ত্বের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কেবলমাত্র শক্তির দ্বন্দ্ব বা রাষ্ট্রস্বার্থ নয়, বরং নৈতিকতা, আন্তঃনির্ভরতাবোধ, এবং বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিক্রিয়ায় উদারনৈতিক তত্ত্ব বিকশিত হয়, যা যুদ্ধ, সংঘাত ও স্বার্থবাদের বাইরে গিয়ে এক ধরণের সহযোগিতামূলক ও মানবিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।
উদারনৈতিক তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. মানব প্রকৃতির ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি (Optimistic View of Human Nature): উদারনৈতিক তত্ত্বের ভিত্তি হল এই বিশ্বাস যে মানুষ মূলত যুক্তিনিষ্ঠ, নৈতিক, এবং সহযোগিতাপ্রবণ। এই চিন্তাধারা অনুযায়ী, মানুষের মধ্যে শুধু স্বার্থপরতা নেই, বরং তারা পরস্পরের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও উন্নয়নের জন্য কাজ করতে পারে। এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই উদারনীতিবাদীরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও একই রকম ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ রাখেন।
২. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও আন্তঃনির্ভরতা (International Cooperation and Interdependence): লিবারেল থিওরির অন্যতম মুখ্য বৈশিষ্ট্য হলো আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া। এই তত্ত্ব অনুসারে, রাষ্ট্রগুলো কেবল প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নয়, বরং সহযোগিতার মাধ্যমেও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ও উন্নয়ন সাধন করতে পারে। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ও পরিবেশগত আন্তঃনির্ভরতাই রাষ্ট্রগুলিকে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে, যা সংঘাত নয় বরং শান্তি ও উন্নয়নের পথ তৈরি করে।
৩. গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতি (Democracy and Free Market Economy): উদারনীতিবাদীরা মনে করেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা অনেক কম থাকে। কারণ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমতের প্রাধান্য থাকে এবং জনগণ সাধারণত যুদ্ধ চায় না। একইসঙ্গে মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে জড়িত থাকে, যা যুদ্ধের পরিবর্তে পারস্পরিক স্বার্থ ও বোঝাপড়ার ভিত্তি তৈরি করে।
৪. আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আইন (Role of International Institutions and Law): উদারনৈতিক তত্ত্বে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, WTO ইত্যাদির মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। এই প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা, সমন্বয় এবং শান্তিপূর্ণ বিবাদ নিষ্পত্তিতে সহায়তা করে। আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে একটি কাঠামোগত বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।
৫. শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য (Commitment to Peace): উদারনৈতিক তত্ত্ব আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটি 'শূন্য-যোগ' (Zero-Sum) নয় বরং 'ধনাত্মক যোগফল' (Positive-Sum) খেলা হিসেবে দেখে। অর্থাৎ, সব পক্ষ একসাথে লাভবান হতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে, লিবারেল থিওরি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিপরীতে কূটনৈতিক আলোচনা ও বোঝাপড়ার উপর গুরুত্ব দেয়।
ইতিহাসে উদারনৈতিক তত্ত্বের প্রভাব ও বিকাশ: উদারনৈতিক তত্ত্বের শিকড় ১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীর ইউরোপীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যে নিহিত, যার মধ্যে জন লক, ইমানুয়েল কান্ত ও জেরেমি বেন্থামের নাম উল্লেখযোগ্য। ইমানুয়েল কান্ত তার “Perpetual Peace” প্রবন্ধে বলেছিলেন, যদি বিশ্বজুড়ে প্রজাতান্ত্রিক সরকার থাকে, তবে যুদ্ধ অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন বিশ্ব বিধ্বস্ত হয়, তখন আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লিগ অফ নেশনস গঠিত হয়—এটি ছিল একেবারে লিবারেল থিওরির ভিত্তির বাস্তব প্রয়োগ। যদিও এটি সফল হয়নি, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থাগুলো উদারনৈতিক চিন্তার ফল।
১৯৭০-এর দশকে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির বিকাশ, গ্লোবালাইজেশন, এবং বাণিজ্যিক আন্তঃনির্ভরতা উদারনীতিবাদকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
লিবারেল থিওরি বনাম বাস্তববাদ (Realism):
বিষয় | লিবারেল থিওরি | বাস্তববাদ |
---|---|---|
মানুষের প্রকৃতি | ইতিবাচক | নেতিবাচক |
রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য | শান্তি ও সহযোগিতা | ক্ষমতা অর্জন ও নিরাপত্তা |
আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা | পরিবর্তনশীল ও গঠনযোগ্য | নৈরাজ্যবাদী ও অপরিবর্তনীয় |
যুদ্ধের কারণ | অবিশ্বাস ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা | ক্ষমতা ও স্বার্থবিরোধ |
শান্তির উপায় | আন্তর্জাতিক আইন, প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্য | ভারসাম্য রক্ষা, শক্তি ব্যবহার |
উদাহরণ ও বাস্তব প্রয়োগ:
১. ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) – যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটি সফল উদাহরণ।
২. জাতিসংঘ (UNO) – আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় একটি উদারনৈতিক কাঠামো।
৩. WTO ও IMF – বৈশ্বিক অর্থনীতিতে লিবারেল থিওরির প্রয়োগ ও আন্তঃনির্ভরতা বৃদ্ধির প্রতীক।
৪. Climate Change Agreement (Paris Accord) – রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা।
সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ: যদিও উদারনৈতিক তত্ত্ব অনেক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেয়, তবুও বাস্তবতার নিরিখে এই তত্ত্বের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে:
• কিছু রাষ্ট্র এখনো জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা করে না।
• জাতিসংঘ বা অন্যান্য সংস্থা অনেক সময় বড় শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রভাবে প্রভাবিত হয়।
• গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও মাঝে মাঝে যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব ঘটে (যেমন: ভারত-পাকিস্তান)।
তবুও, বর্তমান বৈশ্বিক বিশ্বব্যবস্থায় উদারনীতিবাদ একটি বিকল্প ও আশাব্যঞ্জক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যা যুদ্ধ, সংঘাত এবং স্বার্থপরতার বাইরেও মানবিক মূল্যবোধ ও শান্তির পক্ষপাতিত্ব করে।
উপসংহার: আন্তর্জাতিক সম্পর্কে উদারনৈতিক তত্ত্ব কেবল একটি রাজনৈতিক তত্ত্ব নয়, বরং এটি একটি মানবিক দর্শন। এই তত্ত্ব আমাদের শেখায় কিভাবে সহযোগিতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে একটি নিরাপদ ও উন্নত বিশ্ব গঠন করা যায়। শক্তির রাজনীতির জগতে এটি একটি আশার আলো, যা কূটনৈতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং বৈশ্বিক নাগরিকত্বকে উৎসাহিত করে।
বিশ্বব্যাপী আন্তঃনির্ভরতাবোধ ও গ্লোবাল চ্যালেঞ্জের (যেমন: জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারী, সন্ত্রাসবাদ) প্রেক্ষিতে উদারনীতিবাদ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। এ কারণেই আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বোঝার জন্য উদারনৈতিক তত্ত্ব একটি অপরিহার্য কাঠামো হিসেবে বিবেচিত।
Unit 4- জাতীয় শক্তি
*****4) প্রশ্ন.জাতীয় শক্তি বলতে কী বোঝায়? জাতীয় শক্তির উপাদানসমূহ আলোচনা কর। (১০)
ভূমিকা: একটি রাষ্ট্র কেবল ভূখণ্ড, জনগণ ও সরকার দ্বারা গঠিত হয় না; বরং তার প্রকৃত ক্ষমতা নির্ধারিত হয় জাতীয় শক্তির দ্বারা। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে টিকে থাকা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক ও সামরিক উন্নতি অর্জন এবং বৈদেশিক নীতিকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য জাতীয় শক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। এটি একটি রাষ্ট্রের সার্বিক ক্ষমতা এবং প্রভাবের প্রতিচ্ছবি।
জাতীয় শক্তি বলতে কী বোঝায়?
জাতীয় শক্তি (National Power) বলতে বোঝায়—একটি রাষ্ট্রের সেই সামগ্রিক ক্ষমতা, যার মাধ্যমে সে অভ্যন্তরীণভাবে শাসন পরিচালনা করতে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের স্বার্থ রক্ষা ও অন্য রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এটি একটি বহুমাত্রিক ধারণা, যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, ভূ-রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত দিকসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হান্স জে. মরগেনথাউ (Hans J. Morgenthau) বলেন,
“জাতীয় শক্তি হল সেই মাধ্যম, যার দ্বারা একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।”
অন্যদিকে, Ray S. Cline বলেন,
“জাতীয় শক্তি এমন একটি গাণিতিক পরিমাপযোগ্য শক্তি, যা একটি দেশের কূটনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রচেষ্টার ফলাফল।”
সুতরাং, জাতীয় শক্তি হলো একটি দেশের সম্ভাব্যতা, সম্পদ ও সংগঠনের সামষ্টিক রূপ, যা তাকে জাতীয় লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করে।
জাতীয় শক্তির উপাদানসমূহ: জাতীয় শক্তি একক কোনো উপাদানের উপর নির্ভরশীল নয়; বরং এটি বহু উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। নিচে জাতীয় শক্তির প্রধান উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করে দেখানো হলো—
✅ ১. ভৌগোলিক উপাদান: ভৌগোলিক অবস্থান, আয়তন, ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু একটি রাষ্ট্রের শক্তি নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনুকূল ভৌগোলিক অবস্থান যেমন – বন্দরনগরী বা জলপথের নিকটে অবস্থিত দেশগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যে লাভবান হয়। বৃহৎ আয়তন যেমন রাশিয়া বা চীনের ক্ষেত্রে সামরিক ও প্রতিরক্ষা দিক থেকে উপকারী। পাহাড়-পর্বত যেমন নিরাপত্তা দেয়, তেমনি যোগাযোগে বাধাও দেয়। জলবায়ু মানুষের পরিশ্রমের মান নির্ধারণ করে। নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু উন্নয়নের জন্য অনুকূল। অতএব, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য একটি শক্ত রাষ্ট্র নির্মাণে সহায়ক।
✅ ২. জনসংখ্যা বা মানবসম্পদ: জাতীয় শক্তির অন্যতম স্তম্ভ হলো জনসংখ্যা। এটি শুধু পরিমাণের দিক থেকে নয়, গুণগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশ যত বেশি দক্ষ, শিক্ষিত ও উৎপাদনক্ষম জনগণ ধারণ করবে, সে দেশ তত বেশি উন্নত ও শক্তিশালী হতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, চীনের জনসংখ্যা বিশাল হলেও তার নিয়ন্ত্রিত ও উৎপাদনক্ষম জনবলের কারণে বিশ্বশক্তি হয়ে উঠেছে। মানবসম্পদের ওপর নির্ভর করে সামরিক বাহিনী গঠিত হয়, প্রশাসন পরিচালিত হয় এবং শিল্পোন্নয়ন ঘটে। অতএব, জনসংখ্যা কেবল সংখ্যা নয়, এটি একটি কৌশলগত শক্তি।
✅ ৩. প্রাকৃতিক সম্পদ: প্রাকৃতিক সম্পদ জাতীয় শক্তির একটি অপরিহার্য উপাদান। খনিজ, তেল, ইউরেনিয়াম, লৌহ ইত্যাদি আধুনিক প্রতিরক্ষা ও শিল্পোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কৃষিজ সম্পদ ও খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনও একটি রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে তোলে। একটি রাষ্ট্র যদি তার প্রাকৃতিক সম্পদ সঠিকভাবে আহরণ ও ব্যবহার করতে পারে, তাহলে তা কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, আন্তর্জাতিক প্রভাবও বৃদ্ধি করে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি তেলের জন্য বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি, কৃষি, স্বাস্থ্য এবং প্রতিরক্ষার জন্যও প্রাকৃতিক সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ।
✅ ৪. অর্থনৈতিক সামর্থ্য: একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি নির্ভর করে তার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির ওপর। একটি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সক্রিয় অংশ নিতে পারে, উন্নত সামরিক প্রযুক্তি অর্জন করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা দিতে সক্ষম হয়। যেমন জাপান বা জার্মানির মত দেশ অর্থনীতির মাধ্যমে শক্তিশালী হয়েছে। অর্থনৈতিক শক্তি দেশের অন্যান্য উপাদানের উন্নয়নের জন্যও প্রয়োজনীয়। শিক্ষা, প্রযুক্তি, সামরিক, কূটনীতি সব কিছুর ভিত্তি হলো অর্থ। আন্তর্জাতিক ঋণ বা সাহায্য ছাড়াই টিকে থাকা ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্থনৈতিক শক্তির অন্যতম সূচক।
✅ ৫. সামরিক শক্তি: সামরিক শক্তি হলো সেই উপাদান, যার মাধ্যমে একটি দেশ তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে ও বিদেশি হুমকির মোকাবিলা করে। আধুনিক যুগে সামরিক শক্তি মানে শুধু সৈন্য সংখ্যা নয়, বরং প্রযুক্তিগত আধুনিকতা, পরমাণু শক্তি, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি ও সাইবার প্রতিরক্ষা দক্ষতা। একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে দেশটির অবস্থান মজবুত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা চীনের মতো রাষ্ট্রগুলো তাদের সামরিক শক্তির জন্যই বিশ্বে বড় শক্তি হিসেবে বিবেচিত। ফলে সামরিক শক্তি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও প্রভাব বিস্তারের অপরিহার্য উপাদান।
✅ ৬. সরকারের প্রকৃতি ও প্রশাসনিক দক্ষতা: একটি দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং প্রশাসনিক কাঠামো তার জাতীয় শক্তির গুরুত্বপূর্ন ভিত্তি। একটি স্থিতিশীল ও কার্যকর সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা করে এবং পররাষ্ট্রনীতির সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে। হ্যান্স জে মর্গেনথাউ বলেন, উৎকৃষ্ট সরকার ছাড়া শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি গড়া সম্ভব নয়। দক্ষ আমলাতন্ত্র, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং নীতি-নির্ধারণে স্বচ্ছতা রাষ্ট্রের শক্তিকে বৃদ্ধি করে। যেমন, সিঙ্গাপুর বা জার্মানির প্রশাসনিক দক্ষতা তাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও প্রভাব বাড়িয়েছে।
✅ ৭. জাতীয় চরিত্র ও আত্মবিশ্বাস: জাতীয় শক্তি গঠনে দেশের নাগরিকদের মনোভাব ও দেশপ্রেমও গুরুত্বপূর্ণ। যদি জনগণের মধ্যে ঐক্য, আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায় এবং আত্মত্যাগের মানসিকতা থাকে, তাহলে দেশটি যেকোনো সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। ইতিহাসে ভিয়েতনামের উদাহরণ স্মরণীয় – দেশটি প্রলম্বিত যুদ্ধে আমেরিকার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে সফল হয়েছিল। জাতীয় চরিত্রের দৃঢ়তা ও জাতিগত সংহতি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এটি এক অদৃশ্য শক্তি, যা জাতীয় শক্তিকে ভিতর থেকে শক্তিশালী করে তোলে।
✅ ৮. কূটনীতি: কূটনীতি জাতীয় শক্তির প্রয়োগ ও সম্প্রসারণের একটি প্রধান মাধ্যম। আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি দেশের ভাবমূর্তি, সম্পর্ক, সমঝোতা ও বন্ধুত্ব কূটনৈতিক দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। মর্গেনথাউ বলেছেন, কূটনীতি জাতীয় শক্তির মস্তিষ্ক। শক্তি প্রয়োগের আগে কূটনৈতিক চেষ্টাই রাষ্ট্রের প্রধান হাতিয়ার। সফল কূটনীতির মাধ্যমে একটি দেশ যুদ্ধ ছাড়াই তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। যেমন – ভারতের “ন্যাম” বা চীনের “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ” বিশ্বরাজনীতিতে কূটনৈতিক দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ। তাই কূটনীতি হলো শক্তিকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিচালনার কৌশল।
✅ উপসংহার:
জাতীয় শক্তি একটি বহুমাত্রিক ধারণা, যা একক উপাদান দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। এটি একাধিক উপাদানের সম্মিলিত শক্তি। ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ, সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা, কূটনৈতিক দক্ষতা ও প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গঠিত। আধুনিক বিশ্বে প্রযুক্তির অগ্রগতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তথ্য ও সাইবার যুদ্ধ নতুন উপাদান হিসেবে যুক্ত হচ্ছে।