
Kalyani University Suggestion
Kalyani University B.A 3rd Semester History Major Nep Suggestions 2026
Ancient India from the Post-Vedic to Late Gupta Period
Kalyani University B.A 3rd Semester History Major Nep ছোট প্রশ্ন, বড়ো প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন PDF টি পেতে.. আপনি 99 টাকা পেমেন্ট করুন। পেমেন্টের পর এক সেকেন্ডের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাজেশনটি পাবেন। ধন্যবাদ। টাকা টি পেমেন্ট করার জন্য নিচে PAY বাটনে ক্লিক করুন।
অথবা আপনি চাইলে সরাসরি PhonePe-এর মাধ্যমে 99 টাকা পেমেন্ট করে সাজেশন সংগ্রহ করতে পারেন। PhonePe নম্বর: 6295668424 (পেমেন্টের পর স্ক্রিনশট হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালে PDF COPY পাঠিয়ে দেব।)
My Phone Number- 6295668424
• এই সাজেশনের বড়ো প্রশ্ন সংখ্যা 28 টি।
ছোট প্রশ্ন প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন পাবেন।
• নিরক্ষরেখে বলতে পারি এই সাজেশনেরর বাইরে কোন প্রশ্ন উত্তর আসবে না।
• ১০০% তোমরা কমন পাবে।
• এই সাজেশনের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সিলেবাস অনুযায়ী এবং ইউনিট
অনুযায়ী সাজানো রয়েছে ।
• তোমরা চাইলে খুব সহজে BUY করতে পারো।
• THANK YOU.
এখানে অল্প কিছু প্রশ্নোত্তর আপলোড করা হয়েছে যদি তোমার মনে হয় সাজেশনটি BUY করতে পারো ।
(সিলেবাস – ২০২৫)
Unit–1: ভারতে বৈদিক-পরবর্তী রাজনীতির বৈশিষ্ট্য — মগধে মৌর্য শাসন, অশোকের ধম্ম ও প্রশাসন, সাংস্কৃতিক বিজয়ের নীতি।
Unit–2: মৌর্য-পরবর্তী ভারতে কুষাণ, সাতবাহন ও তামিল শক্তি — চেরা, চোল ও পাণ্ড্য। উপজাতির কৃষিকাজ ও বর্ণপ্রথার পরিবর্তনের ফলে মেগালিথিক সংস্কৃতির বিস্তার; জৈন ও বৌদ্ধধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম, শৈবধর্ম।
Unit–3: গুপ্ত সাম্রাজ্যের একীকরণ; গুপ্ত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ; উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের আঞ্চলিক রাজ্যগুলির স্বর্ণযুগ; পতনের উপর বিতর্ক; প্রাচীন ভারতে সামন্তবাদের উপর বিতর্ক।
Unit–4: প্রারম্ভিক যুগে শিল্প ও স্থাপত্য; সাহিত্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি; বাণিজ্য, শিল্প ও গিল্ড ব্যবস্থা; সমাজ, সংস্কৃতি ও পরিবেশ; নতুন নগরায়নের সূচনা।
এখানে অল্প কিছু প্রশ্নোত্তর আপলোড করা হয়েছে যদি তোমার মনে হয় সাজেশনটি BUY করতে পারো ।
Unit – 1: বৈদিক-পরবর্তী রাজনীতি, মৌর্য শাসন, অশোক ও সাংস্কৃতিক নীতি।
*****1) প্রশ্ন. মৌর্য শাসনব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো। (৫) অথবা, তুমি কি মনে করো যে মৌর্য শাসনব্যবস্থা একটি কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র ছিল? (৫/১০)
ভূমিকা: ভারতের ইতিহাসে মৌর্য সাম্রাজ্য (৩২২ খ্রিস্টপূর্ব – ১৮৫ খ্রিস্টপূর্ব) ছিল প্রথম এবং বৃহত্তম কেন্দ্রীয় রাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্য। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, তার পুত্র বিন্দুসার এবং পৌত্র অশোকের হাত ধরে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা, সম্প্রসারণ এবং সুসংহত হয়েছিল। মৌর্য শাসনব্যবস্থা শুধু রাজনৈতিক দিক থেকেই নয়, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও এক অভিনব উদাহরণ। আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, মৌর্য যুগেই প্রথমবারের মতো ভারতে একটি সুদৃঢ়, কেন্দ্রীভূত ও আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা পরবর্তী ভারতীয় শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
মৌর্য শাসনব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্র: মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল রাজাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শক্তিশালী প্রশাসন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি ছিলেন শাসন, সেনা, আইন এবং ধর্মের প্রধান নিয়ন্ত্রক। তবে তিনি এককভাবে শাসন করতেন না; বরং বিভিন্ন মন্ত্রী ও আমলাদের মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালনা করতেন।
২. মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টা পরিষদ: রাজাকে সাহায্য করার জন্য ছিল একটি শক্তিশালী মন্ত্রিসভা। এর মধ্যে ছিলেন প্রধান মন্ত্রী (মহামাত্র বা প্রধানোপাধ্যায়), সেনাপতি, অর্থমন্ত্রী এবং বিচারপতি প্রভৃতি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য আলাদা আলাদা উচ্চপদস্থ আমলা নিযুক্ত থাকত।
৩. সুসংগঠিত আমলাতন্ত্র: মৌর্য শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল আমলাতন্ত্রের শক্তিশালী ভূমিকা। কর আদায়, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, কৃষি ও বাণিজ্য তদারকি, জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদন— এসব কাজের জন্য অসংখ্য আমলা নিযুক্ত ছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশাসক বা গভর্নর নিযুক্ত থাকলেও তাদের সবাইকে রাজধানী থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো।
৪. প্রাদেশিক প্রশাসন: সমগ্র সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছিল। প্রতিটি প্রদেশের শাসনভার ছিল রাজকুমার বা রাজপরিবারের সদস্যদের হাতে। এভাবে কেন্দ্র থেকে সরাসরি প্রদেশগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। প্রদেশের অধীনে জেলা, গ্রাম ও মৌজা পর্যায়েও প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে।
৫. গুপ্তচর বিভাগ: মৌর্য শাসনব্যবস্থার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল সুসংগঠিত গুপ্তচর বাহিনী। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা ও শত্রুর গতিবিধি নজরে রাখতে বিভিন্ন ছদ্মবেশী গুপ্তচর নিযুক্ত ছিল।
৬. কর ব্যবস্থা: রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল কর আদায়। কৃষির উপর প্রধান কর আরোপ করা হতো, যা সাধারণত উৎপাদনের এক-ষষ্ঠাংশ। এছাড়া বাণিজ্য, শিল্প, খনি, বনজ সম্পদ ও পশুপালন থেকেও কর আদায় করা হতো। রাজকোষে সংগৃহীত এই কর রাষ্ট্রের সামরিক ও প্রশাসনিক খরচে ব্যয় হতো।
৭. সামরিক শক্তি: মৌর্য সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী ছিল সমকালীন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী। গ্রিক ইতিহাসবিদ মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেছেন যে, মৌর্য সেনাবাহিনীতে প্রায় ৬ লক্ষ সৈন্য, ৩০ হাজার অশ্বারোহী, ৯ হাজার হাতি এবং ৮ হাজার রথ ছিল। এই সামরিক শক্তিই সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রেখেছিল।
৮. আইন ও বিচার ব্যবস্থা: রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক। তবে বাস্তবিক বিচারকার্য পরিচালনা করতেন নিযুক্ত বিচারপতিরা। ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় প্রকার মামলা আদালতে নিষ্পত্তি করা হতো। অপরাধীদের জন্য শাস্তি ছিল কঠোর।
৯. রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র: রাজধানী পাটলিপুত্র ছিল প্রশাসনিক কার্যকলাপের কেন্দ্র। এখানে প্রাসাদ, দপ্তর, করকেন্দ্র ও সেনানিবাস ছিল। মেগাস্থিনিস রাজধানীর জাঁকজমকপূর্ণ বর্ণনা দিয়েছেন।
১০. জনকল্যাণ ও ধর্মনীতি: বিশেষত অশোকের সময় থেকে জনকল্যাণমূলক কাজ যেমন— রাস্তা, হাসপাতাল, বিশ্রামাগার, কূপ, উদ্যান প্রভৃতি নির্মাণ করা হয়েছিল। এছাড়া অশোকের ‘ধম্মনীতি’ শাসনব্যবস্থাকে মানবিক রূপ দেয়।
মৌর্য শাসনব্যবস্থা কি কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র ছিল?
ক) কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য:
১. ক্ষমতার মূল কেন্দ্র রাজা।
২. প্রদেশীয় প্রশাসন সরাসরি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে।
৩. বিশাল আমলাতান্ত্রিক কাঠামো।
৪. প্রশাসনিক প্রতিটি স্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত আমলা।
৫. কর সংগ্রহ ও সেনাবাহিনী কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত।
খ) মৌর্য প্রশাসনের সঙ্গে তুলনা: মৌর্য শাসনব্যবস্থায় উপরোক্ত সব বৈশিষ্ট্যই স্পষ্টভাবে দেখা যায়। রাজা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। প্রদেশ ও গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত প্রশাসন কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র প্রমাণ করে যে, মৌর্য প্রশাসন ছিল আমলাতান্ত্রিক এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীকৃত।
গ) অশোকের সময়ে পরিবর্তন: অশোক তার ধম্মনীতি প্রয়োগ করে কিছুটা মানবিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তবে প্রশাসনিক কাঠামো অপরিবর্তিত ছিল। রাজকীয় আদেশ (শিলালিপি) সরাসরি জনসাধারণকে জানানো হতো। এটিও এক ধরনের কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া।
উপসংহার: সবদিক বিচার করলে বলা যায় যে, মৌর্য শাসনব্যবস্থা ছিল ভারতের প্রথম সুসংগঠিত, কেন্দ্রীভূত এবং আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন। রাজাকে কেন্দ্র করে যে বিশাল প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে, তার মধ্যে ছিল মন্ত্রিপরিষদ, কর ব্যবস্থা, সামরিক শক্তি, গুপ্তচর বিভাগ, আইন ও বিচারপ্রণালী ইত্যাদি। এই ব্যবস্থার ফলে মৌর্য সাম্রাজ্য এত বিশাল ভৌগোলিক বিস্তার লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। অশোকের সময় জনকল্যাণ ও ধর্মনীতি যুক্ত হওয়ায় এই প্রশাসন আরও মানবিক রূপ পায়।
অতএব, মৌর্য শাসনব্যবস্থা শুধু প্রাচীন ভারতের নয়, সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যেখানে আমরা একাধারে কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্র এবং আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের পরিপূর্ণ রূপ দেখতে পাই।
মৌর্য শাসনব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্র: মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল রাজাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শক্তিশালী প্রশাসন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি ছিলেন শাসন, সেনা, আইন এবং ধর্মের প্রধান নিয়ন্ত্রক। তবে তিনি এককভাবে শাসন করতেন না; বরং বিভিন্ন মন্ত্রী ও আমলাদের মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালনা করতেন।
২. মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টা পরিষদ: রাজাকে সাহায্য করার জন্য ছিল একটি শক্তিশালী মন্ত্রিসভা। এর মধ্যে ছিলেন প্রধান মন্ত্রী (মহামাত্র বা প্রধানোপাধ্যায়), সেনাপতি, অর্থমন্ত্রী এবং বিচারপতি প্রভৃতি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য আলাদা আলাদা উচ্চপদস্থ আমলা নিযুক্ত থাকত।
৩. সুসংগঠিত আমলাতন্ত্র: মৌর্য শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল আমলাতন্ত্রের শক্তিশালী ভূমিকা। কর আদায়, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, কৃষি ও বাণিজ্য তদারকি, জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদন— এসব কাজের জন্য অসংখ্য আমলা নিযুক্ত ছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশাসক বা গভর্নর নিযুক্ত থাকলেও তাদের সবাইকে রাজধানী থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো।
৪. প্রাদেশিক প্রশাসন: সমগ্র সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছিল। প্রতিটি প্রদেশের শাসনভার ছিল রাজকুমার বা রাজপরিবারের সদস্যদের হাতে। এভাবে কেন্দ্র থেকে সরাসরি প্রদেশগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। প্রদেশের অধীনে জেলা, গ্রাম ও মৌজা পর্যায়েও প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে।
৫. গুপ্তচর বিভাগ: মৌর্য শাসনব্যবস্থার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল সুসংগঠিত গুপ্তচর বাহিনী। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা ও শত্রুর গতিবিধি নজরে রাখতে বিভিন্ন ছদ্মবেশী গুপ্তচর নিযুক্ত ছিল।
৬. কর ব্যবস্থা: রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল কর আদায়। কৃষির উপর প্রধান কর আরোপ করা হতো, যা সাধারণত উৎপাদনের এক-ষষ্ঠাংশ। এছাড়া বাণিজ্য, শিল্প, খনি, বনজ সম্পদ ও পশুপালন থেকেও কর আদায় করা হতো। রাজকোষে সংগৃহীত এই কর রাষ্ট্রের সামরিক ও প্রশাসনিক খরচে ব্যয় হতো।
৭. সামরিক শক্তি: মৌর্য সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী ছিল সমকালীন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী। গ্রিক ইতিহাসবিদ মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেছেন যে, মৌর্য সেনাবাহিনীতে প্রায় ৬ লক্ষ সৈন্য, ৩০ হাজার অশ্বারোহী, ৯ হাজার হাতি এবং ৮ হাজার রথ ছিল। এই সামরিক শক্তিই সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রেখেছিল।
৮. আইন ও বিচার ব্যবস্থা: রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক। তবে বাস্তবিক বিচারকার্য পরিচালনা করতেন নিযুক্ত বিচারপতিরা। ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় প্রকার মামলা আদালতে নিষ্পত্তি করা হতো। অপরাধীদের জন্য শাস্তি ছিল কঠোর।
৯. রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র: রাজধানী পাটলিপুত্র ছিল প্রশাসনিক কার্যকলাপের কেন্দ্র। এখানে প্রাসাদ, দপ্তর, করকেন্দ্র ও সেনানিবাস ছিল। মেগাস্থিনিস রাজধানীর জাঁকজমকপূর্ণ বর্ণনা দিয়েছেন।
১০. জনকল্যাণ ও ধর্মনীতি: বিশেষত অশোকের সময় থেকে জনকল্যাণমূলক কাজ যেমন— রাস্তা, হাসপাতাল, বিশ্রামাগার, কূপ, উদ্যান প্রভৃতি নির্মাণ করা হয়েছিল। এছাড়া অশোকের ‘ধম্মনীতি’ শাসনব্যবস্থাকে মানবিক রূপ দেয়।
মৌর্য শাসনব্যবস্থা কি কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র ছিল?
ক) কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য:
১. ক্ষমতার মূল কেন্দ্র রাজা।
২. প্রদেশীয় প্রশাসন সরাসরি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে।
৩. বিশাল আমলাতান্ত্রিক কাঠামো।
৪. প্রশাসনিক প্রতিটি স্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত আমলা।
৫. কর সংগ্রহ ও সেনাবাহিনী কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত।
খ) মৌর্য প্রশাসনের সঙ্গে তুলনা: মৌর্য শাসনব্যবস্থায় উপরোক্ত সব বৈশিষ্ট্যই স্পষ্টভাবে দেখা যায়। রাজা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। প্রদেশ ও গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত প্রশাসন কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র প্রমাণ করে যে, মৌর্য প্রশাসন ছিল আমলাতান্ত্রিক এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীকৃত।
গ) অশোকের সময়ে পরিবর্তন: অশোক তার ধম্মনীতি প্রয়োগ করে কিছুটা মানবিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তবে প্রশাসনিক কাঠামো অপরিবর্তিত ছিল। রাজকীয় আদেশ (শিলালিপি) সরাসরি জনসাধারণকে জানানো হতো। এটিও এক ধরনের কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া।
উপসংহার: সবদিক বিচার করলে বলা যায় যে, মৌর্য শাসনব্যবস্থা ছিল ভারতের প্রথম সুসংগঠিত, কেন্দ্রীভূত এবং আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন। রাজাকে কেন্দ্র করে যে বিশাল প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে, তার মধ্যে ছিল মন্ত্রিপরিষদ, কর ব্যবস্থা, সামরিক শক্তি, গুপ্তচর বিভাগ, আইন ও বিচারপ্রণালী ইত্যাদি। এই ব্যবস্থার ফলে মৌর্য সাম্রাজ্য এত বিশাল ভৌগোলিক বিস্তার লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। অশোকের সময় জনকল্যাণ ও ধর্মনীতি যুক্ত হওয়ায় এই প্রশাসন আরও মানবিক রূপ পায়।
অতএব, মৌর্য শাসনব্যবস্থা শুধু প্রাচীন ভারতের নয়, সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যেখানে আমরা একাধারে কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্র এবং আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের পরিপূর্ণ রূপ দেখতে পাই।
Unit – 2: কুষাণ, সাতবাহন, তামিল শক্তি, মেগালিথিক সংস্কৃতি ও ধর্ম।
*****2) প্রশ্ন. সাতবাহন রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর অবদান আলোচনা কর। (১০ নম্বর, ২০২৩)
✦ ভূমিকা: ভারতের ইতিহাসে সাতবাহন রাজবংশ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এসেছে বিপ্লব। এর মধ্যে সামাজিক মাধ্যম (Social Media) অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র, যা মানুষের যোগাযোগ, বিনোদন, তথ্য বিনিময়, এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, টুইটার (এক্স), টেলিগ্রাম ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম আজকের প্রজন্মের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে তরুণ ও ছাত্রছাত্রীদের জীবনধারায় সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। তবে প্রশ্ন দেখা দেয়—এই মাধ্যম কি ছাত্রছাত্রীদের পাঠের প্রতি অমনোযোগী করে তুলছে? নাকি সঠিক ব্যবহারে এটি শিক্ষার জন্য সহায়ক হতে পারে? এই বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
✦ পারিবারিক পরিচয় ও রাজ্যে অভিষেক: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ছিলেন সাতবাহন বংশের একজন প্রধান রাজা এবং মহারাষ্ট্র অঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক। তাঁর নাম থেকেই স্পষ্ট, তিনি ছিলেন তাঁর মাতা গৌতমীর পুত্র। সাতবাহন রাজবংশে মাতৃ-নাম অনুসারে পুত্র পরিচয়ের এই প্রথা এক বিশেষ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। প্রাচীন শিলালিপি ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে দেখা যায়, গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর রাজত্বকাল ছিল খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে। তিনি তাঁর পিতা ও পূর্ববর্তী দুর্বল শাসকদের থেকে ভিন্নভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন এবং সাতবাহন সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
✦ সাম্রাজ্য বিস্তার ও রাজনৈতিক অবদান: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ছিলেন একজন দক্ষ ও বীর সেনাপতি। তিনি তাঁর শাসনকালে সাতবাহন সাম্রাজ্যকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। পশ্চিম ভারতের শক্তিশালী ও প্রতাপশালী কুষ্ঠান রাজবংশের নাহপান নামক রাজাকে পরাজিত করে সাতবাহনদের পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনেন।
✦ নাহপানকে পরাজয়: গৌতমীপুত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সামরিক কৃতিত্ব ছিল শক্তিশালী শক রাজা নাহপানকে পরাজিত করা। এই জয়ে তিনি পশ্চিম ভারতে (বিশেষতঃ মালভা, সৌরাষ্ট্র, কঙ্কণ অঞ্চল) সাতবাহন কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ‘নানাঘাট’ এবং ‘নাসিক’ শিলালিপিতে এই বিজয়ের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
✦ উত্তরে ও দক্ষিণে অভিযান: তিনি শুধু পশ্চিমেই নয়, উত্তর ভারতেও কৌশলগতভাবে রাজ্য বিস্তার করেন। ভিক্ষুকদের দানপত্র ও প্রত্নতত্ত্বে প্রাপ্ত প্রমাণে জানা যায়, তিনি পশ্চিম ভারতের পাশাপাশি উত্তর ও দক্ষিণ দিকেও তার সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। দক্ষিণে চোল, চেরা ও পাণ্ড্যদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাদের দমন করেন।
✦ শাসনব্যবস্থা ও প্রশাসন: সেনা-বিজয়ের পাশাপাশি তিনি প্রশাসনিক সংস্কারেও বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। রাজ্যকে বিভিন্ন প্রদেশে ভাগ করে রাজকর্মচারীদের মাধ্যমে শাসন করতেন। করব্যবস্থার সংস্কার, নগর উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রশাসনিক অবদান।
✦ ধর্মীয় অবদান ও সহনশীলতা: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এক উদার ও সহনশীল শাসক ছিলেন। তিনি হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ ধর্মালম্বী হলেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিও সহনশীল মনোভাব পোষণ করতেন। তাঁর মা গৌতমী বালশ্রী নিজেও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং পুত্রের নামে অনেক বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহার নির্মাণ করেছিলেন।
✦ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা: তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নানাঘাট ও নাসিক শিলালিপি থেকে জানা যায়, তিনি নিজেকে 'এক ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়' হিসেবে পরিচয় দিতেন এবং ব্রাহ্মণদের দান-দক্ষিণা দিতেন।
✦ বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি সহনশীলতা: যদিও তিনি হিন্দুধর্মাবলম্বী ছিলেন, তবুও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিও উদার মনোভাব দেখিয়েছেন। তাঁর মায়ের দানপত্রে উল্লেখ আছে যে, তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য বহু স্থাপত্য নির্মাণে সহায়তা করেছেন।
✦ অর্থনৈতিক অবদান: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর শাসনকালে অর্থনৈতিক উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়। তাঁর রৌপ্যমুদ্রা ও সোনার মুদ্রা থেকে স্পষ্ট যে, বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা সমৃদ্ধ ছিল। তিনি বিদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন, বিশেষত রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে। বন্দর নগরীগুলি যেমন নাসিক, অপরান্ত, সোপারা ইত্যাদি তৎকালে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়।
✦ বাণিজ্য: বিদেশি মুদ্রা (বিশেষত রোমান স্বর্ণমুদ্রা) প্রাপ্তির ফলে বোঝা যায় যে, রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল। সেতু, সড়ক, বন্দর নির্মাণ ও করব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও গতি আসে।
✦ সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্যিক অবদান: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর শাসনকালে বহু স্তূপ, বিহার, গুহা এবং শিলালিপি নির্মিত হয়। নাসিক ও কানহেরি গুহার নির্মাণ তাঁর শাসনকালেই হয় বলে জানা যায়। তাঁর মাতা গৌতমীর দ্বারা দানকৃত নাসিক গুহা অন্যতম বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এসব গুহা শুধু ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের জন্য নয়, বরং শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
✦ নারীর ভূমিকা: মাতা গৌতমী বালশ্রীর অবদান: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর শাসন ও কৃতিত্বের পিছনে তাঁর মাতা গৌতমী বালশ্রীর প্রভাব অসীম। তিনি একজন শক্তিশালী ও প্রভাবশালী নারী ছিলেন, যিনি শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই নয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করেন। নাসিকের গুহায় যে শিলালিপি পাওয়া গেছে, তা গৌতমী বালশ্রীর নামেই খোদিত। এই শিলালিপিতে তাঁর পুত্রের শৌর্য, ধর্মনিষ্ঠা, রাজনীতি এবং দানের বিস্তারিত বিবরণ আছে।
✦ ঐতিহাসিক গুরুত্ব: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী শুধু একজন রাজা ছিলেন না; তিনি ছিলেন একটি যুগের প্রতীক। তিনি যে কৌশল, সহনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা এবং রাজনৈতিক দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন, তা তাঁকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাচীন শাসকের মর্যাদা দিয়েছে।
তাঁর শাসনামলে –
• সাতবাহন রাজবংশের পুনরুত্থান ঘটে।
• দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
• সামাজিক ঐক্য, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটে।
• নারীর ভূমিকা, বিশেষত মাতৃশক্তির গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়।
✦ উপসংহার: সার্বিকভাবে বিচার করলে, গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ছিলেন সাতবাহন রাজবংশের শ্রেষ্ঠতম রাজা। তিনি শুধু একজন শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী শাসক নন, বরং একজন দূরদর্শী প্রশাসক, ধর্মনিষ্ঠ, সংস্কৃতিবান এবং জনগণের কল্যাণকামী রাজা ছিলেন। তাঁর শাসনকাল প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগ হিসেবে চিহ্নিত হয়। তাঁর সামরিক সাফল্য, ধর্মীয় সহনশীলতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং মাতা গৌতমী বালশ্রীর প্রভাব—সব মিলিয়ে তাঁকে একটি সর্বোৎকৃষ্ট শাসকের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। অতএব, গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর অবদান নিঃসন্দেহে ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়।
✦ পারিবারিক পরিচয় ও রাজ্যে অভিষেক: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ছিলেন সাতবাহন বংশের একজন প্রধান রাজা এবং মহারাষ্ট্র অঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক। তাঁর নাম থেকেই স্পষ্ট, তিনি ছিলেন তাঁর মাতা গৌতমীর পুত্র। সাতবাহন রাজবংশে মাতৃ-নাম অনুসারে পুত্র পরিচয়ের এই প্রথা এক বিশেষ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। প্রাচীন শিলালিপি ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে দেখা যায়, গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর রাজত্বকাল ছিল খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে। তিনি তাঁর পিতা ও পূর্ববর্তী দুর্বল শাসকদের থেকে ভিন্নভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন এবং সাতবাহন সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
✦ সাম্রাজ্য বিস্তার ও রাজনৈতিক অবদান: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ছিলেন একজন দক্ষ ও বীর সেনাপতি। তিনি তাঁর শাসনকালে সাতবাহন সাম্রাজ্যকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। পশ্চিম ভারতের শক্তিশালী ও প্রতাপশালী কুষ্ঠান রাজবংশের নাহপান নামক রাজাকে পরাজিত করে সাতবাহনদের পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনেন।
✦ নাহপানকে পরাজয়: গৌতমীপুত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সামরিক কৃতিত্ব ছিল শক্তিশালী শক রাজা নাহপানকে পরাজিত করা। এই জয়ে তিনি পশ্চিম ভারতে (বিশেষতঃ মালভা, সৌরাষ্ট্র, কঙ্কণ অঞ্চল) সাতবাহন কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ‘নানাঘাট’ এবং ‘নাসিক’ শিলালিপিতে এই বিজয়ের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
✦ উত্তরে ও দক্ষিণে অভিযান: তিনি শুধু পশ্চিমেই নয়, উত্তর ভারতেও কৌশলগতভাবে রাজ্য বিস্তার করেন। ভিক্ষুকদের দানপত্র ও প্রত্নতত্ত্বে প্রাপ্ত প্রমাণে জানা যায়, তিনি পশ্চিম ভারতের পাশাপাশি উত্তর ও দক্ষিণ দিকেও তার সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। দক্ষিণে চোল, চেরা ও পাণ্ড্যদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাদের দমন করেন।
✦ শাসনব্যবস্থা ও প্রশাসন: সেনা-বিজয়ের পাশাপাশি তিনি প্রশাসনিক সংস্কারেও বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। রাজ্যকে বিভিন্ন প্রদেশে ভাগ করে রাজকর্মচারীদের মাধ্যমে শাসন করতেন। করব্যবস্থার সংস্কার, নগর উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রশাসনিক অবদান।
✦ ধর্মীয় অবদান ও সহনশীলতা: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এক উদার ও সহনশীল শাসক ছিলেন। তিনি হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ ধর্মালম্বী হলেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিও সহনশীল মনোভাব পোষণ করতেন। তাঁর মা গৌতমী বালশ্রী নিজেও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং পুত্রের নামে অনেক বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহার নির্মাণ করেছিলেন।
✦ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা: তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নানাঘাট ও নাসিক শিলালিপি থেকে জানা যায়, তিনি নিজেকে 'এক ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়' হিসেবে পরিচয় দিতেন এবং ব্রাহ্মণদের দান-দক্ষিণা দিতেন।
✦ বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি সহনশীলতা: যদিও তিনি হিন্দুধর্মাবলম্বী ছিলেন, তবুও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিও উদার মনোভাব দেখিয়েছেন। তাঁর মায়ের দানপত্রে উল্লেখ আছে যে, তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য বহু স্থাপত্য নির্মাণে সহায়তা করেছেন।
✦ অর্থনৈতিক অবদান: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর শাসনকালে অর্থনৈতিক উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়। তাঁর রৌপ্যমুদ্রা ও সোনার মুদ্রা থেকে স্পষ্ট যে, বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা সমৃদ্ধ ছিল। তিনি বিদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন, বিশেষত রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে। বন্দর নগরীগুলি যেমন নাসিক, অপরান্ত, সোপারা ইত্যাদি তৎকালে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়।
✦ বাণিজ্য: বিদেশি মুদ্রা (বিশেষত রোমান স্বর্ণমুদ্রা) প্রাপ্তির ফলে বোঝা যায় যে, রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল। সেতু, সড়ক, বন্দর নির্মাণ ও করব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও গতি আসে।
✦ সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্যিক অবদান: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর শাসনকালে বহু স্তূপ, বিহার, গুহা এবং শিলালিপি নির্মিত হয়। নাসিক ও কানহেরি গুহার নির্মাণ তাঁর শাসনকালেই হয় বলে জানা যায়। তাঁর মাতা গৌতমীর দ্বারা দানকৃত নাসিক গুহা অন্যতম বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এসব গুহা শুধু ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের জন্য নয়, বরং শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
✦ নারীর ভূমিকা: মাতা গৌতমী বালশ্রীর অবদান: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর শাসন ও কৃতিত্বের পিছনে তাঁর মাতা গৌতমী বালশ্রীর প্রভাব অসীম। তিনি একজন শক্তিশালী ও প্রভাবশালী নারী ছিলেন, যিনি শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই নয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করেন। নাসিকের গুহায় যে শিলালিপি পাওয়া গেছে, তা গৌতমী বালশ্রীর নামেই খোদিত। এই শিলালিপিতে তাঁর পুত্রের শৌর্য, ধর্মনিষ্ঠা, রাজনীতি এবং দানের বিস্তারিত বিবরণ আছে।
✦ ঐতিহাসিক গুরুত্ব: গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী শুধু একজন রাজা ছিলেন না; তিনি ছিলেন একটি যুগের প্রতীক। তিনি যে কৌশল, সহনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা এবং রাজনৈতিক দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন, তা তাঁকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাচীন শাসকের মর্যাদা দিয়েছে।
তাঁর শাসনামলে –
• সাতবাহন রাজবংশের পুনরুত্থান ঘটে।
• দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
• সামাজিক ঐক্য, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটে।
• নারীর ভূমিকা, বিশেষত মাতৃশক্তির গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়।
✦ উপসংহার: সার্বিকভাবে বিচার করলে, গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ছিলেন সাতবাহন রাজবংশের শ্রেষ্ঠতম রাজা। তিনি শুধু একজন শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী শাসক নন, বরং একজন দূরদর্শী প্রশাসক, ধর্মনিষ্ঠ, সংস্কৃতিবান এবং জনগণের কল্যাণকামী রাজা ছিলেন। তাঁর শাসনকাল প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগ হিসেবে চিহ্নিত হয়। তাঁর সামরিক সাফল্য, ধর্মীয় সহনশীলতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং মাতা গৌতমী বালশ্রীর প্রভাব—সব মিলিয়ে তাঁকে একটি সর্বোৎকৃষ্ট শাসকের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। অতএব, গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর অবদান নিঃসন্দেহে ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়।
Unit – 3: গুপ্ত সাম্রাজ্য, বিকেন্দ্রীকরণ, আঞ্চলিক স্বর্ণযুগ ও সামন্তবাদ বিতর্ক।
*****3) প্রশ্ন.মৌর্যোত্তর ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে এর পার্থক্য কী ছিল? (১০)
ভূমিকা: ভারতের ইতিহাসে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রায় এক সহস্রাব্দকাল জুড়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনগুলি সংঘটিত হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামন্ততন্ত্রের উত্থান। মৌর্যোত্তর ভারতে সাম্রাজ্যভিত্তিক শক্তির অবক্ষয়, আঞ্চলিক রাজ্যগুলির বিকাশ, ভূমি রাজস্ব পদ্ধতির পরিবর্তন, কৃষিভিত্তিক সমাজ কাঠামোর বিকাশ এবং সামরিক সংগঠনের পুনর্গঠন সামন্ততন্ত্রকে জন্ম দেয়। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের ধারণা অনেকটা সামরিক চুক্তি ও ভাসালেজ ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে থাকলেও ভারতে এটি মূলত ভূমি-রাজস্ব, কৃষি উৎপাদন ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ভিত্তিতে বিকশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধে আমরা মৌর্যোত্তর ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করব এবং তা ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করব।
মৌর্যোত্তর ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য:
১. রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ: মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে।
ফলে আঞ্চলিক রাজা ও সামন্তরা ক্রমশ স্বাধীন শক্তিতে পরিণত হন। রাজারা বৃহৎ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে অক্ষম হয়ে পড়েন, তাই তারা নিজেদের অঞ্চলের শাসনভার সামন্ত প্রভুদের হাতে ন্যস্ত করেন। এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জমিদার ও সামরিক নেতারা রাজশক্তির প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন।
২. ভূমি দান ও ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা: ভারতে সামন্ততন্ত্র গঠনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল ভূমি অনুদান ব্যবস্থা।
রাজারা যুদ্ধজয়ী সেনাপতি, ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চবর্গকে কৃষিজমি দান করতেন। এই ভূমির উপর প্রাপকরা (সামন্ত) রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করত। ফলে কৃষকরা প্রত্যক্ষভাবে রাজার প্রতি নয়, বরং সামন্ত প্রভুর প্রতি বাধ্য হয়ে পড়ত।
৩. সামরিক বাধ্যবাধকতা: সামন্ত প্রভুরা রাজাকে যুদ্ধের সময় সৈন্য ও সামরিক সহায়তা প্রদান করতেন।
এর বিনিময়ে তারা জমি, ক্ষমতা ও বিশেষাধিকারের অধিকারী হতেন। এর ফলে সামরিক শক্তি কেন্দ্র থেকে স্থানীয় প্রভুদের হাতে ছড়িয়ে পড়ে।
৪. কৃষকের উপর নির্ভরশীলতা: ভারতীয় সামন্ততন্ত্র ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক।
কৃষকরা জমিতে উৎপাদন করত এবং তার একটি বড় অংশ কর বা খাজনা হিসাবে সামন্ত প্রভুর হাতে জমা দিত। অনেক ক্ষেত্রে কৃষকেরা অর্ধদাসত্ব অবস্থায় পড়ে যেত, কারণ তাদের জমি ছেড়ে যাওয়ার অধিকার ছিল না।
৫. উত্তরাধিকার সূত্রে সামন্ত প্রথার বিস্তার: প্রথমদিকে ভূমিদান ছিল সাময়িক, কিন্তু পরে তা উত্তরাধিকার সূত্রে স্থায়ী হয়ে যায়।
ফলে সামন্ত প্রভুরা ধীরে ধীরে স্বাধীন ভূস্বামীতে রূপান্তরিত হন।
৬. বর্ণভিত্তিক প্রভাব: ভারতীয় সমাজে সামন্ততন্ত্রের বিকাশে বর্ণব্যবস্থা একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
ব্রাহ্মণরা ভূমিদান পেয়ে "অগ্নিহোত্র ভূমি" বা "ব্রাহ্মণ্য ভূমি" প্রতিষ্ঠা করতেন। এভাবে সামাজিক ও ধর্মীয় কর্তৃত্বের সঙ্গে সামন্ততন্ত্র অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়।
৭. অর্থনৈতিক স্থবিরতা: সামন্ততান্ত্রিক সমাজে নগরায়ণ ও বাণিজ্য কার্যক্রম ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।
কারণ উৎপাদনের প্রধান অংশ স্থানীয় খরচেই ব্যয় হত এবং বহির্বাণিজ্যের গুরুত্ব কমে যায়। এ কারণে ভারতীয় অর্থনীতি দীর্ঘকাল ধরে স্থবিরতার শিকার হয়।
৮. রাজশক্তির আনুগত্য: যদিও সামন্তরা কার্যত স্বাধীন শাসক হয়ে ওঠেন, তথাপি আনুষ্ঠানিকভাবে তারা রাজাকে সুপ্রভু হিসাবে স্বীকার করতেন এবং নিয়মিত কর প্রদান বা সামরিক সহায়তা দিতেন।
ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য:
১. ভাসালেজ (Vassalage) পদ্ধতি: ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র মূলত রাজা, প্রভু (lord) ও ভাসালদের সম্পর্কের উপর দাঁড়িয়ে ছিল।
ভাসালরা শপথ গ্রহণ করে তাদের প্রভুকে সামরিক সহায়তা দিত এবং এর বিনিময়ে ভূমি বা ‘ফিফ’ পেত।
২. সামরিক চরিত্র: ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র ছিল প্রধানত সামরিক ভিত্তিক।
নাইট ও ভাসালদের প্রধান কর্তব্য ছিল রাজাকে যুদ্ধে সাহায্য করা।
৩. চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক: ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রে ভূমি দান হতো চুক্তি বা ফিউডাল চুক্তি (Feudal Contract) অনুসারে।
৪. কৃষক বা সার্ফডম: ইউরোপে কৃষকদের বলা হতো সার্ফ।
তারা জমির সঙ্গে বাঁধা থাকত এবং প্রভুর অনুমতি ছাড়া অন্যত্র যেতে পারত না।
৫. চার্চের প্রভাব: ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রে চার্চ একটি বিশাল ভূমিকা পালন করত।
পোপ ও চার্চ রাজনীতিতে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
৬. কেন্দ্রীয় দুর্বলতা: ইউরোপেও কেন্দ্রীয় রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
ছোট ছোট সামন্ত প্রভুরা কার্যত স্বাধীন রাজা হয়ে উঠেছিলেন।
ভারতীয় ও ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য:
উত্পত্তি: মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভূমিদান ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে গড়ে ওঠে।
ভিত্তি: ভূমিদান ও কৃষিজ উৎপাদন।
সামরিক দিক: সামন্তরা সৈন্য সরবরাহ করলেও সামরিক দিক ছিল গৌণ।
ধর্মীয় প্রভাব: বর্ণব্যবস্থা ও ব্রাহ্মণ্য প্রভাব প্রবল।
কৃষকের অবস্থা: কৃষকরা খাজনা দিত, অনেক ক্ষেত্রে অর্ধদাসত্বে আবদ্ধ হত।
অর্থনীতি: গ্রামীণ অর্থনীতি প্রাধান্য পায়, নগর ও বাণিজ্য কার্যক্রম হ্রাস পায়।
আইনি চরিত্র: ভূমিদান প্রথমে সাময়িক হলেও পরে স্থায়ী ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়।
রাজশক্তির প্রতি আনুগত্য: সামন্তরা রাজাকে নামমাত্র প্রভু হিসেবে মানত।
উপসংহার: ভারতের মৌর্যোত্তর যুগে সামন্ততন্ত্র শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনই নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনেরও প্রতিফলন। এটি কেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্য থেকে আঞ্চলিক শক্তির বিকাশের যুগ নির্দেশ করে। ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে, ভারতীয় সামন্ততন্ত্র ভূমিদান, কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ও বর্ণব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিল; অন্যদিকে ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র সামরিক চুক্তি, ভাসালেজ এবং চার্চের প্রভাবের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
অতএব বলা যায়, ভারতীয় ও ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র উভয়ই কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার ফসল হলেও তাদের বিকাশের ধারা, চরিত্র ও সামাজিক প্রভাব একেবারেই ভিন্ন।
মৌর্যোত্তর ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য:
১. রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ: মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে।
ফলে আঞ্চলিক রাজা ও সামন্তরা ক্রমশ স্বাধীন শক্তিতে পরিণত হন। রাজারা বৃহৎ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে অক্ষম হয়ে পড়েন, তাই তারা নিজেদের অঞ্চলের শাসনভার সামন্ত প্রভুদের হাতে ন্যস্ত করেন। এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জমিদার ও সামরিক নেতারা রাজশক্তির প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন।
২. ভূমি দান ও ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা: ভারতে সামন্ততন্ত্র গঠনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল ভূমি অনুদান ব্যবস্থা।
রাজারা যুদ্ধজয়ী সেনাপতি, ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চবর্গকে কৃষিজমি দান করতেন। এই ভূমির উপর প্রাপকরা (সামন্ত) রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করত। ফলে কৃষকরা প্রত্যক্ষভাবে রাজার প্রতি নয়, বরং সামন্ত প্রভুর প্রতি বাধ্য হয়ে পড়ত।
৩. সামরিক বাধ্যবাধকতা: সামন্ত প্রভুরা রাজাকে যুদ্ধের সময় সৈন্য ও সামরিক সহায়তা প্রদান করতেন।
এর বিনিময়ে তারা জমি, ক্ষমতা ও বিশেষাধিকারের অধিকারী হতেন। এর ফলে সামরিক শক্তি কেন্দ্র থেকে স্থানীয় প্রভুদের হাতে ছড়িয়ে পড়ে।
৪. কৃষকের উপর নির্ভরশীলতা: ভারতীয় সামন্ততন্ত্র ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক।
কৃষকরা জমিতে উৎপাদন করত এবং তার একটি বড় অংশ কর বা খাজনা হিসাবে সামন্ত প্রভুর হাতে জমা দিত। অনেক ক্ষেত্রে কৃষকেরা অর্ধদাসত্ব অবস্থায় পড়ে যেত, কারণ তাদের জমি ছেড়ে যাওয়ার অধিকার ছিল না।
৫. উত্তরাধিকার সূত্রে সামন্ত প্রথার বিস্তার: প্রথমদিকে ভূমিদান ছিল সাময়িক, কিন্তু পরে তা উত্তরাধিকার সূত্রে স্থায়ী হয়ে যায়।
ফলে সামন্ত প্রভুরা ধীরে ধীরে স্বাধীন ভূস্বামীতে রূপান্তরিত হন।
৬. বর্ণভিত্তিক প্রভাব: ভারতীয় সমাজে সামন্ততন্ত্রের বিকাশে বর্ণব্যবস্থা একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
ব্রাহ্মণরা ভূমিদান পেয়ে "অগ্নিহোত্র ভূমি" বা "ব্রাহ্মণ্য ভূমি" প্রতিষ্ঠা করতেন। এভাবে সামাজিক ও ধর্মীয় কর্তৃত্বের সঙ্গে সামন্ততন্ত্র অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়।
৭. অর্থনৈতিক স্থবিরতা: সামন্ততান্ত্রিক সমাজে নগরায়ণ ও বাণিজ্য কার্যক্রম ধীরে ধীরে হ্রাস পায়।
কারণ উৎপাদনের প্রধান অংশ স্থানীয় খরচেই ব্যয় হত এবং বহির্বাণিজ্যের গুরুত্ব কমে যায়। এ কারণে ভারতীয় অর্থনীতি দীর্ঘকাল ধরে স্থবিরতার শিকার হয়।
৮. রাজশক্তির আনুগত্য: যদিও সামন্তরা কার্যত স্বাধীন শাসক হয়ে ওঠেন, তথাপি আনুষ্ঠানিকভাবে তারা রাজাকে সুপ্রভু হিসাবে স্বীকার করতেন এবং নিয়মিত কর প্রদান বা সামরিক সহায়তা দিতেন।
ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য:
১. ভাসালেজ (Vassalage) পদ্ধতি: ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র মূলত রাজা, প্রভু (lord) ও ভাসালদের সম্পর্কের উপর দাঁড়িয়ে ছিল।
ভাসালরা শপথ গ্রহণ করে তাদের প্রভুকে সামরিক সহায়তা দিত এবং এর বিনিময়ে ভূমি বা ‘ফিফ’ পেত।
২. সামরিক চরিত্র: ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র ছিল প্রধানত সামরিক ভিত্তিক।
নাইট ও ভাসালদের প্রধান কর্তব্য ছিল রাজাকে যুদ্ধে সাহায্য করা।
৩. চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক: ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রে ভূমি দান হতো চুক্তি বা ফিউডাল চুক্তি (Feudal Contract) অনুসারে।
৪. কৃষক বা সার্ফডম: ইউরোপে কৃষকদের বলা হতো সার্ফ।
তারা জমির সঙ্গে বাঁধা থাকত এবং প্রভুর অনুমতি ছাড়া অন্যত্র যেতে পারত না।
৫. চার্চের প্রভাব: ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রে চার্চ একটি বিশাল ভূমিকা পালন করত।
পোপ ও চার্চ রাজনীতিতে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
৬. কেন্দ্রীয় দুর্বলতা: ইউরোপেও কেন্দ্রীয় রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
ছোট ছোট সামন্ত প্রভুরা কার্যত স্বাধীন রাজা হয়ে উঠেছিলেন।
ভারতীয় ও ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য:
উত্পত্তি: মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভূমিদান ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে গড়ে ওঠে।
ভিত্তি: ভূমিদান ও কৃষিজ উৎপাদন।
সামরিক দিক: সামন্তরা সৈন্য সরবরাহ করলেও সামরিক দিক ছিল গৌণ।
ধর্মীয় প্রভাব: বর্ণব্যবস্থা ও ব্রাহ্মণ্য প্রভাব প্রবল।
কৃষকের অবস্থা: কৃষকরা খাজনা দিত, অনেক ক্ষেত্রে অর্ধদাসত্বে আবদ্ধ হত।
অর্থনীতি: গ্রামীণ অর্থনীতি প্রাধান্য পায়, নগর ও বাণিজ্য কার্যক্রম হ্রাস পায়।
আইনি চরিত্র: ভূমিদান প্রথমে সাময়িক হলেও পরে স্থায়ী ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়।
রাজশক্তির প্রতি আনুগত্য: সামন্তরা রাজাকে নামমাত্র প্রভু হিসেবে মানত।
উপসংহার: ভারতের মৌর্যোত্তর যুগে সামন্ততন্ত্র শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনই নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনেরও প্রতিফলন। এটি কেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্য থেকে আঞ্চলিক শক্তির বিকাশের যুগ নির্দেশ করে। ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে, ভারতীয় সামন্ততন্ত্র ভূমিদান, কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ও বর্ণব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিল; অন্যদিকে ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র সামরিক চুক্তি, ভাসালেজ এবং চার্চের প্রভাবের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
অতএব বলা যায়, ভারতীয় ও ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র উভয়ই কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার ফসল হলেও তাদের বিকাশের ধারা, চরিত্র ও সামাজিক প্রভাব একেবারেই ভিন্ন।
Unit – 4: শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, বাণিজ্য-গিল্ড, সমাজ-সংস্কৃতি ও নগরায়ন।
*****4) প্রশ্ন. গান্ধার শিল্পের উপর একটি টীকা লেখো। (৫)
ভূমিকা: ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে গান্ধার শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধু ভারতীয় শিল্পের ধারাবাহিকতাকেই সমৃদ্ধ করেনি, বরং ভারতীয় ও বিদেশি শিল্পধারার এক অনন্য মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন শিল্পশৈলীর মধ্যে গান্ধার শিল্পকে "গ্রিক-বৌদ্ধ শিল্প" নামেও অভিহিত করা হয়। কারণ এই শিল্পধারায় ভারতীয় বৌদ্ধ ভাবধারার সঙ্গে গ্রিক-রোমান শিল্পকলা ও ভাস্কর্যকলার প্রভাব সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত এই শিল্প বিকাশ লাভ করে। বিশেষত, কুষাণ যুগে সম্রাট কনিষ্কের সময়ে এর সর্বাধিক বিকাশ ঘটে।
গান্ধার শিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশ: গান্ধার অঞ্চল বর্তমানে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও আফগানিস্তানের কাবুল উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই অঞ্চলটি প্রাচীনকাল থেকেই ভারত, ইরান ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে সাংস্কৃতিক সংযোগস্থল হিসেবে পরিচিত।
• আলেকজান্ডারের অভিযান (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক) – গান্ধার অঞ্চলে গ্রিক প্রভাব বিস্তার করে। গ্রিক শিল্পধারা, বিশেষ করে হেলেনিস্টিক ভাস্কর্যকলার প্রভাব এখানে গড়ে ওঠে।
• পরবর্তীকালে মৌর্য শাসন এবং অশোকের ধম্মপ্রচার – এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মকে বিস্তার ঘটায়।
• কুষাণ যুগে, বিশেষত কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতায় – গান্ধার শিল্পের এক সোনালি যুগের সূচনা হয়।
গান্ধার শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য: গান্ধার শিল্পের বিশেষত্ব হলো ভারতীয় বৌদ্ধ ভাবধারা ও গ্রিক-রোমান ভাস্কর্যকলার এক চমৎকার সংমিশ্রণ। এর মধ্যে কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে আলোচনা করা হলো—
১. বৌদ্ধ ভাবধারা ও গ্রিক প্রভাব: গান্ধার শিল্পে মূলত বৌদ্ধ ধর্মীয় কাহিনী, বিশেষত গৌতম বুদ্ধের জীবন ও ধর্মীয় ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে ভাস্কর্য ও চিত্রকলা নির্মিত হয়। তবে এর রূপায়ণে ব্যবহৃত হয়েছে গ্রিক-রোমান ভাস্কর্যকলার কৌশল। যেমন—বাস্তবধর্মী দেহগঠন, পোশাকের ভাঁজ, মুখাবয়বের গ্রীক আদর্শ সৌন্দর্য ইত্যাদি।
২. প্রথম বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ: ভারতীয় শিল্পে প্রাথমিকভাবে বুদ্ধকে প্রতীকী রূপে (পদচিহ্ন, ধর্মচক্র, বৃক্ষ, সিংহাসন ইত্যাদি) উপস্থাপন করা হতো। কিন্তু গান্ধার শিল্পেই প্রথমবারের মতো মানব আকৃতিতে বুদ্ধমূর্তি গড়ে তোলা হয়। এর ফলে শিল্পকলায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়।
৩. বাস্তবধর্মিতা ও দেহরূপ: গান্ধার ভাস্কর্যে মানুষের শরীরকে বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মাংসপেশীর গঠন, দেহের ভারসাম্য, মুখাবয়বের সূক্ষ্ম রেখা – সবই প্রায় জীবন্ত মনে হয়।
৪. পোশাক ও অলঙ্কার: গান্ধার শিল্পে বুদ্ধ ও অন্যান্য চরিত্রকে গ্রীক ধাঁচের চাদর (টোকারি বা টোগা) পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। পোশাকের ভাঁজগুলি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা হয়েছে, যা গ্রিক ভাস্কর্যের অনুকরণে করা।
৫. উপাদান: মূলত ধূসর বেলেপাথর ও স্টুকো (চুন-সুরকি মিশ্রণ) দিয়ে গান্ধার ভাস্কর্য নির্মিত হতো। পরে ব্রোঞ্জ দিয়েও কিছু ভাস্কর্য গড়া হয়েছিল।
৬. বিষয়বস্তু: বুদ্ধের জন্ম, বোধিলাভ, ধর্মপ্রচার, মহাপরিনির্বাণ ইত্যাদি ঘটনা ছাড়াও জাতককথার বিভিন্ন কাহিনী গান্ধার শিল্পে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
গান্ধার শিল্পের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ:
১. গান্ধার বুদ্ধমূর্তি: যেখানে বুদ্ধকে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় গ্রীক ধাঁচের পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়।
২. বুদ্ধের জন্মকাহিনী: যেখানে মায়াদেবীকে গাছের ডাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় এবং পাশে বিভিন্ন দিকপাল বা দেবতাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
৩. বোধিলাভ দৃশ্য: বুদ্ধকে বোধিবৃক্ষের নিচে ধ্যানরত অবস্থায় বসানো হয়েছে।
৪. মহাপরিনির্বাণ: বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণকে অত্যন্ত শান্ত ও গম্ভীর ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়েছে।
৫. জাতককাহিনী চিত্রিত ভাস্কর্য: যেমন বুদ্ধের পূর্বজন্মের কাহিনী।
অন্যান্য সমসাময়িক শিল্পের সঙ্গে তুলনা:
• মথুরা শিল্পে: বুদ্ধকে ভারতীয় ধাঁচে অর্ধনগ্ন দেহে, গম্ভীর অথচ স্নিগ্ধ ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হতো।
• গান্ধার শিল্পে: গ্রীক প্রভাবে বুদ্ধকে পূর্ণবস্ত্রাবৃত অবস্থায় এবং দেহের গঠনকে বাস্তবানুগভাবে রূপায়ণ করা হয়েছে।
• তুলনা: মথুরা শিল্প বেশি দেশীয়, আর গান্ধার শিল্প বেশি আন্তর্জাতিক ধাঁচের।
গান্ধার শিল্পের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব:
১. শিল্পকলার বিকাশে অবদান: গান্ধার শিল্প ভারতীয় ভাস্কর্যকলায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এর মাধ্যমে ভারতীয় শিল্প মানবমূর্তি নির্মাণের এক যুগান্তকারী অধ্যায়ে প্রবেশ করে।
২. সংস্কৃতির সংমিশ্রণ: এটি ভারতীয় ও গ্রিক সংস্কৃতির মিলনের এক অনন্য নিদর্শন। এর ফলে ভারতীয় শিল্প বৈশ্বিক পরিসরে স্বীকৃতি পায়।
৩. বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারে ভূমিকা: গান্ধার শিল্প বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও কাহিনীকে চিত্রিত করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। মধ্য এশিয়া, চীন, কোরিয়া ও জাপান পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারে এই শিল্প বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৪. ঐতিহাসিক দলিল: গান্ধার ভাস্কর্য ও প্রত্নসম্পদ থেকে প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়।
উপসংহার: গান্ধার শিল্প শুধু ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে নয়, বিশ্ব শিল্পকলার ইতিহাসেও এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। এটি ছিল এক অসাধারণ সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের ফল, যেখানে ভারতীয় বৌদ্ধ ভাবধারা ও গ্রিক-রোমান শিল্পশৈলী মিলেমিশে গড়ে তুলেছিল এক অনন্য ধারা। গান্ধার শিল্পের মধ্য দিয়ে প্রথম মানবমূর্তিতে বুদ্ধের প্রতিমা নির্মিত হয়, যা পরবর্তীতে সমগ্র এশিয়ায় বৌদ্ধ শিল্পের বিস্তার ঘটায়। সুতরাং, গান্ধার শিল্প ভারতীয় ঐতিহ্য ও বৈশ্বিক সংস্কৃতির এক চিরস্থায়ী সেতুবন্ধন হিসেবে আজও মানবসভ্যতার ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
গান্ধার শিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশ: গান্ধার অঞ্চল বর্তমানে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও আফগানিস্তানের কাবুল উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই অঞ্চলটি প্রাচীনকাল থেকেই ভারত, ইরান ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে সাংস্কৃতিক সংযোগস্থল হিসেবে পরিচিত।
• আলেকজান্ডারের অভিযান (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক) – গান্ধার অঞ্চলে গ্রিক প্রভাব বিস্তার করে। গ্রিক শিল্পধারা, বিশেষ করে হেলেনিস্টিক ভাস্কর্যকলার প্রভাব এখানে গড়ে ওঠে।
• পরবর্তীকালে মৌর্য শাসন এবং অশোকের ধম্মপ্রচার – এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মকে বিস্তার ঘটায়।
• কুষাণ যুগে, বিশেষত কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতায় – গান্ধার শিল্পের এক সোনালি যুগের সূচনা হয়।
গান্ধার শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য: গান্ধার শিল্পের বিশেষত্ব হলো ভারতীয় বৌদ্ধ ভাবধারা ও গ্রিক-রোমান ভাস্কর্যকলার এক চমৎকার সংমিশ্রণ। এর মধ্যে কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে আলোচনা করা হলো—
১. বৌদ্ধ ভাবধারা ও গ্রিক প্রভাব: গান্ধার শিল্পে মূলত বৌদ্ধ ধর্মীয় কাহিনী, বিশেষত গৌতম বুদ্ধের জীবন ও ধর্মীয় ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে ভাস্কর্য ও চিত্রকলা নির্মিত হয়। তবে এর রূপায়ণে ব্যবহৃত হয়েছে গ্রিক-রোমান ভাস্কর্যকলার কৌশল। যেমন—বাস্তবধর্মী দেহগঠন, পোশাকের ভাঁজ, মুখাবয়বের গ্রীক আদর্শ সৌন্দর্য ইত্যাদি।
২. প্রথম বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ: ভারতীয় শিল্পে প্রাথমিকভাবে বুদ্ধকে প্রতীকী রূপে (পদচিহ্ন, ধর্মচক্র, বৃক্ষ, সিংহাসন ইত্যাদি) উপস্থাপন করা হতো। কিন্তু গান্ধার শিল্পেই প্রথমবারের মতো মানব আকৃতিতে বুদ্ধমূর্তি গড়ে তোলা হয়। এর ফলে শিল্পকলায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়।
৩. বাস্তবধর্মিতা ও দেহরূপ: গান্ধার ভাস্কর্যে মানুষের শরীরকে বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মাংসপেশীর গঠন, দেহের ভারসাম্য, মুখাবয়বের সূক্ষ্ম রেখা – সবই প্রায় জীবন্ত মনে হয়।
৪. পোশাক ও অলঙ্কার: গান্ধার শিল্পে বুদ্ধ ও অন্যান্য চরিত্রকে গ্রীক ধাঁচের চাদর (টোকারি বা টোগা) পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। পোশাকের ভাঁজগুলি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা হয়েছে, যা গ্রিক ভাস্কর্যের অনুকরণে করা।
৫. উপাদান: মূলত ধূসর বেলেপাথর ও স্টুকো (চুন-সুরকি মিশ্রণ) দিয়ে গান্ধার ভাস্কর্য নির্মিত হতো। পরে ব্রোঞ্জ দিয়েও কিছু ভাস্কর্য গড়া হয়েছিল।
৬. বিষয়বস্তু: বুদ্ধের জন্ম, বোধিলাভ, ধর্মপ্রচার, মহাপরিনির্বাণ ইত্যাদি ঘটনা ছাড়াও জাতককথার বিভিন্ন কাহিনী গান্ধার শিল্পে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
গান্ধার শিল্পের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ:
১. গান্ধার বুদ্ধমূর্তি: যেখানে বুদ্ধকে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় গ্রীক ধাঁচের পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়।
২. বুদ্ধের জন্মকাহিনী: যেখানে মায়াদেবীকে গাছের ডাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় এবং পাশে বিভিন্ন দিকপাল বা দেবতাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
৩. বোধিলাভ দৃশ্য: বুদ্ধকে বোধিবৃক্ষের নিচে ধ্যানরত অবস্থায় বসানো হয়েছে।
৪. মহাপরিনির্বাণ: বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণকে অত্যন্ত শান্ত ও গম্ভীর ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়েছে।
৫. জাতককাহিনী চিত্রিত ভাস্কর্য: যেমন বুদ্ধের পূর্বজন্মের কাহিনী।
অন্যান্য সমসাময়িক শিল্পের সঙ্গে তুলনা:
• মথুরা শিল্পে: বুদ্ধকে ভারতীয় ধাঁচে অর্ধনগ্ন দেহে, গম্ভীর অথচ স্নিগ্ধ ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হতো।
• গান্ধার শিল্পে: গ্রীক প্রভাবে বুদ্ধকে পূর্ণবস্ত্রাবৃত অবস্থায় এবং দেহের গঠনকে বাস্তবানুগভাবে রূপায়ণ করা হয়েছে।
• তুলনা: মথুরা শিল্প বেশি দেশীয়, আর গান্ধার শিল্প বেশি আন্তর্জাতিক ধাঁচের।
গান্ধার শিল্পের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব:
১. শিল্পকলার বিকাশে অবদান: গান্ধার শিল্প ভারতীয় ভাস্কর্যকলায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এর মাধ্যমে ভারতীয় শিল্প মানবমূর্তি নির্মাণের এক যুগান্তকারী অধ্যায়ে প্রবেশ করে।
২. সংস্কৃতির সংমিশ্রণ: এটি ভারতীয় ও গ্রিক সংস্কৃতির মিলনের এক অনন্য নিদর্শন। এর ফলে ভারতীয় শিল্প বৈশ্বিক পরিসরে স্বীকৃতি পায়।
৩. বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারে ভূমিকা: গান্ধার শিল্প বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও কাহিনীকে চিত্রিত করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। মধ্য এশিয়া, চীন, কোরিয়া ও জাপান পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারে এই শিল্প বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৪. ঐতিহাসিক দলিল: গান্ধার ভাস্কর্য ও প্রত্নসম্পদ থেকে প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়।
উপসংহার: গান্ধার শিল্প শুধু ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে নয়, বিশ্ব শিল্পকলার ইতিহাসেও এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। এটি ছিল এক অসাধারণ সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের ফল, যেখানে ভারতীয় বৌদ্ধ ভাবধারা ও গ্রিক-রোমান শিল্পশৈলী মিলেমিশে গড়ে তুলেছিল এক অনন্য ধারা। গান্ধার শিল্পের মধ্য দিয়ে প্রথম মানবমূর্তিতে বুদ্ধের প্রতিমা নির্মিত হয়, যা পরবর্তীতে সমগ্র এশিয়ায় বৌদ্ধ শিল্পের বিস্তার ঘটায়। সুতরাং, গান্ধার শিল্প ভারতীয় ঐতিহ্য ও বৈশ্বিক সংস্কৃতির এক চিরস্থায়ী সেতুবন্ধন হিসেবে আজও মানবসভ্যতার ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।