
Kalyani University Suggestion
Kalyani University B.A 2nd Semester Political Science Major Suggestion 2025
Understanding Political Theory: Approaches and Debates
Kalyani University B.A 2nd Semester Political Science Major ছোট প্রশ্ন, বড়ো প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন PDF টি পেতে.. আপনি 99 টাকা পেমেন্ট করুন। পেমেন্টের পর এক সেকেন্ডের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাজেশনটি পাবেন। ধন্যবাদ। টাকা টি পেমেন্ট করার জন্য নিচে PAY বাটনে ক্লিক করুন।
অথবা আপনি চাইলে সরাসরি PhonePe-এর মাধ্যমে 99 টাকা পেমেন্ট করে সাজেশন সংগ্রহ করতে পারেন। PhonePe নম্বর: 6295668424 (পেমেন্টের পর স্ক্রিনশট হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালে PDF COPY পাঠিয়ে দেব।)
My Phone Number- 6295668424
• এই সাজেশনের বড়ো প্রশ্ন সংখ্যা 35 টি।
ছোট প্রশ্ন প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন পাবেন।
• নিরক্ষরেখে বলতে পারি এই সাজেশনেরর বাইরে কোন প্রশ্ন উত্তর আসবে না।
• ১০০% তোমরা কমন পাবে।
• এই সাজেশনের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সিলেবাস অনুযায়ী এবং ইউনিট
অনুযায়ী সাজানো রয়েছে ।
• তোমরা চাইলে খুব সহজে BUY করতে পারো।
• THANK YOU.
এখানে অল্প কিছু প্রশ্নোত্তর আপলোড করা হয়েছে যদি তোমার মনে হয় সাজেশনটি BUY করতে পারো ।
(সিলেবাস – ২০২৫)
UNIT-1: রাজনৈতিক তত্ত্ব: দৃষ্টিভঙ্গি ও বিতর্ক
নীতিমূলক, আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক, অভিজ্ঞতালব্ধ আচরণবাদী, ব্যবস্থাগত, কাঠামোগত-কার্যকর দৃষ্টিভঙ্গি।
UNIT-2: উদারনীতিবাদ, নয়া-উদারনীতিবাদ, সমাজকল্যাণবাদ।
UNIT-3: নারীবাদ।
UNIT-4: নব্য-মার্কসীয় ধারণা: দ্বন্দ্ববাদ, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।
UNIT-5: রাষ্ট্র, শ্রেণি, শ্রেণিসংগ্রাম, উদ্বৃত্ত মূল্য।
UNIT-6: গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা; দল সম্পর্কে বিতর্ক: লেনিন ও রোজা; বিপ্লব সম্পর্কিত ধারণা: লেনিন ও মাও; গ্রামশি: আধিপত্য ও পুরসামাজিক ধারণা।
Unit–1: রাজনৈতিক তত্ত্ব: দৃষ্টিভঙ্গি ও বিতর্ক
*****1) প্রশ্ন.আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গীর বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ কর। তুমি কি মনে করো যে, আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী অবশেষে সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে? ব্যাখ্যা কর। ৫/১০
ভূমিকা:
আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী হলো একটি বিশেষ ধরনের বিচারিক তত্ত্ব বা দৃষ্টিভঙ্গি, যা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে আইন এবং তার কার্যকারিতা সম্পর্কিত একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে। এই দৃষ্টিভঙ্গীটি তার প্রতিষ্ঠানে এবং আইনগত ব্যবস্থায় একটি প্রতিষ্ঠানিকতা এবং অখণ্ডতা রাখে। আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী বা “Legal Institutional Perspective” মূলত সমাজের বিভিন্ন আইনগত এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে কেন্দ্র করে কাজ করে। এই দৃষ্টিভঙ্গীটি সমাজের আইনব্যবস্থা, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের কর্মপরিধি সম্পর্কিত ধারনাগুলি বিশ্লেষণ করে।
এই বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সমাজে আইনগত কাঠামোর কার্যকারিতা, বিশুদ্ধতা এবং তার পরিবর্তনশীলতার বিষয়টি তুলে ধরে। সেই সাথে, এটি সমাজে আইনের অবস্থান এবং তার মধ্যে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা বিশ্লেষণ করে। এখন প্রশ্ন হলো, এই দৃষ্টিভঙ্গীটি সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে কিনা?
আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গীর বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করার আগে, প্রথমে এই দৃষ্টিভঙ্গীর মূল ধারণাগুলি বুঝে নেওয়া প্রয়োজন।
১. আইনের গুরুত্ব ও প্রতিষ্ঠানগত কাঠামো: আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী, আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংস্থার অংশ হিসেবে গণ্য হয়। এটি কেবলমাত্র একটি নিয়ম নয়, বরং একটি প্রতিষ্ঠান যা রাষ্ট্রের কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী, আইন প্রতিষ্ঠানের অধীনে পরিচালিত হয়, এবং এটি সমাজের ন্যায় বিচার, শৃঙ্খলা এবং সুশাসন বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২. আইনের সামাজিক কার্যকারিতা: আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী আইনকে একটি সামাজিক প্রয়োজন হিসেবে দেখে, যা সমাজে শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে কাজ করে। এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী, সমাজে আইন এক ধরনের সামাজিক চুক্তি হিসেবে কাজ করে, যা সরকারের ও নাগরিকদের মধ্যে একটি মৌলিক সম্পর্ক স্থাপন করে। আইনের কার্যকারিতা এবং তার প্রভাব সমাজে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়।
৩. আইনের অনুশাসন ও শৃঙ্খলা: আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে, আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তার শৃঙ্খলা এবং অনুশাসন। এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী, আইনের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠানের কার্যকরী অভ্যন্তরীণ কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল। একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় থাকে। আইনের অনুশাসন সমাজে অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর বিরাজ করে, যা পুরো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থাকে।
৪. রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রয়োগ: আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগের প্রক্রিয়া এবং শক্তি সম্পর্কেও আলোচনা করে। এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী, রাষ্ট্রের শাসক ক্ষমতা যখন আইনগত কাঠামোর মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়, তখন এটি একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলি সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
৫. সামাজিক পরিবর্তন ও আইনগত পরিবেশ: আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী সামাজিক পরিবর্তন ও আইনের ভূমিকা সম্পর্কেও বিশ্লেষণ করে। এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী, আইন একটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণকারী উপাদান হিসেবে কাজ করে, এবং এটি সমাজের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরিবর্তিত হতে পারে। সমাজের পরিবর্তন অনুযায়ী আইনের কাঠামোও পরিবর্তিত হয় এবং নতুন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়।
আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী কি সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে?
আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গীটি কি এখন সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরটা বেশ জটিল এবং সমাজের বর্তমান পরিস্থিতি এবং পরিবর্তনশীল রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও আইনের ওপর নির্ভরশীল।
অনেকেই মনে করেন, এই দৃষ্টিভঙ্গীটি বর্তমানে পুরানো হয়ে গেছে। কারণ, আধুনিক সমাজের অনেক ক্ষেত্রে আইনের একক কর্তৃত্ব এবং তার প্রতিষ্ঠানিকতার উপর আগের মতো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সারা পৃথিবীতেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যক্রম নতুন ধরনের চিন্তা-ভাবনা, উদ্ভাবনী চিন্তাধারা এবং প্রযুক্তির সহায়তায় পরিবর্তিত হয়েছে। এর ফলে, আইনের প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা পিছনে পড়ে গিয়েছে। তবে, কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী এখনো কার্যকরী।
আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী আজকের দিনে পূর্ণাঙ্গভাবে সাবেকী হয়ে উঠতে পারে না, কারণ রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে আইনের ভূমিকা এখনও গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এটি প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গী, যেমন মানুষের অধিকারের সমর্থন, সমাজের অংশীদারিত্ব এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, আইন ব্যবস্থাকে আরো গতিশীল এবং খোলামেলা করেছে।
উপসংহার:
আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী সমাজে আইনের ভূমিকা ও কার্যকারিতা বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাঠামো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গী আইনকে একটি শক্তিশালী এবং প্রতিষ্ঠিত সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছিল, যা রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা, শাসন এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিল। তবে আধুনিক যুগে, বিশেষত আধুনিক প্রযুক্তি, মানুষের অধিকারের আন্দোলন এবং সমাজে দ্রুত পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে, এই দৃষ্টিভঙ্গীটি অনেক ক্ষেত্রে পুরানো হয়ে পড়েছে।
তবুও, আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী পুরোপুরি সাবেকী হয়ে গেছে এমন বলা যাবে না, কারণ অনেক দেশ ও সমাজে এখনও এটি কার্যকরী। তবে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গী এবং আধুনিক ধারণাগুলোর প্রভাবে, আইনের সংজ্ঞা এবং তার প্রয়োগে আরও নমনীয়তা ও উদারতা এসেছে। আইনের কার্যকারিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পরিবর্তনকে স্বীকার করে, আমরা বলতে পারি যে, আইনগত-প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী একসময়কার একটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাধারা হলেও, আজকের যুগে এটি একটি গতিশীল এবং পরিবর্তিত কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে।
Unit–2: উদারনীতিবাদ, নয়া-উদারনীতিবাদ, সমাজকল্যাণবাদ।
*****2) প্রশ্ন. রাষ্ট্রের নয়া-উদারবাদী তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর। 10/5
ভূমিকা:
নয়া-উদারবাদ (Neoliberalism) বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই তত্ত্বটি মূলত বাজার-অর্থনীতির পূর্ণ মুক্তি, ব্যক্তিগত উদ্যোগের বিস্তার, এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ হ্রাস করার পক্ষপাতী। রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে—এই প্রশ্নটিকে ঘিরেই এই তত্ত্বের রাজনৈতিক এবং নৈতিক বিশ্লেষণ গঠিত হয়েছে। নয়া-উদারবাদী তত্ত্বটি অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শুরু হলেও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রচিন্তার একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বিকশিত হয়েছে। এই আলোচনায় রাষ্ট্রের নয়া-উদারবাদী তত্ত্বের উৎপত্তি, মৌলিক বৈশিষ্ট্য, রাষ্ট্রের ভূমিকার রূপান্তর এবং এর সমালোচনা বিশ্লেষণ করা হবে।
নয়া-উদারবাদের সংজ্ঞা:
নয়া-উদারবাদ এমন একটি মতবাদ যা মুক্তবাজার অর্থনীতিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় এবং বিশ্বাস করে যে ব্যক্তিগত মালিকানা, উদার বাণিজ্য, ও বিনিয়োগের স্বাধীনতা সমাজের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে। এটি মূলত উদারনৈতিক অর্থনীতির আধুনিক রূপ, যা ১৯৭০-এর দশকে পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্রের কাজ হওয়া উচিত—বেসরকারি খাতের সহায়তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করা নয়।
নয়া-উদারবাদের উৎপত্তি ও পটভূমি:
নয়া-উদারবাদের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করতে হলে প্রথমে ১৯৩০-এর দশকের গ্রেট ডিপ্রেশনের দিকে তাকাতে হবে, যেখানে কেঞ্জিয়ান অর্থনৈতিক মডেল জনপ্রিয়তা পায়। রাষ্ট্র তখন জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে এবং অর্থনীতি সচল রাখতে সক্রিয় হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি, তেলের দাম বৃদ্ধি ও আর্থিক মন্দার ফলে কেঞ্জিয়ান মডেলের উপর আস্থা কমে যায়। এই পরিস্থিতিতে ফ্রিডরিখ হায়েক, মিল্টন ফ্রিডম্যানসহ শিকাগো স্কুলের অর্থনীতিবিদরা বাজার-অর্থনীতির পুনরুত্থানের পক্ষে মত দেন। ১৯৮০-র দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান এবং যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এই তত্ত্বকে বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করেন। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) নয়া-উদারবাদের ধারণাগুলিকে উন্নয়নশীল দেশগুলির উপর চাপিয়ে দিতে শুরু করে।
রাষ্ট্রের ভূমিকা: নয়া-উদারবাদী দৃষ্টিকোণ:
নয়া-উদারবাদ রাষ্ট্রের ভূমিকাকে সীমিত রাখতে চায়। এটি মনে করে যে—
- রাষ্ট্র অর্থনীতির ন্যায়বিচার করতে পারে না: রাষ্ট্র অর্থনীতির মধ্যে ঢুকে পড়লে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই রাষ্ট্রের উচিত বাজারের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
- নীতি নির্ধারণে রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত: রাষ্ট্র কেবল আইন প্রয়োগকারী এবং নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
- উদ্যোগ ও বিনিয়োগকে উৎসাহ প্রদান: কর হ্রাস, সাবসিডি তুলে নেওয়া, বেসরকারিকরণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সুবিধা প্রদান রাষ্ট্রের মূল কাজ।
- সামাজিক খাতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সীমিত: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কমিয়ে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা উচিত।
নয়া-উদারবাদী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য:
- বাজার নির্ভরতা: রাষ্ট্র অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাজারের ওপর নির্ভর করে।
- বেসরকারিকরণ: রাষ্ট্র তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেয়।
- উন্মুক্ত বাণিজ্যনীতি: আমদানি-রপ্তানিতে শুল্ক হ্রাস করা হয়।
- কল্যাণ রাষ্ট্রের পশ্চাদপসরণ: রাষ্ট্র আর সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান করে না।
- ব্যক্তিগত সম্পদের গুরুত্ব: ব্যক্তিগত উদ্যোগ, মালিকানা এবং প্রতিযোগিতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
নয়া-উদারবাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব:
নয়া-উদারবাদের ফলে রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তিত হয়। এটি সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ হয়। গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির মানুষের জন্য শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, রেশনিং ব্যবস্থা ইত্যাদি সীমিত হয়ে যায়। রাজনৈতিকভাবে এই তত্ত্ব গণতন্ত্রকে দুর্বল করতে পারে, কারণ নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় বৃহৎ কর্পোরেট শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আধিপত্য বাড়ে।
উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে নয়া-উদারবাদের প্রভাব:
উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলিতে IMF ও World Bank-এর শর্তসাপেক্ষ ঋণের মাধ্যমে নয়া-উদারবাদ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন:
- বেসরকারিকরণ
- কৃষি ও শিল্পে ভর্তুকি প্রত্যাহার
- আমদানি শুল্ক হ্রাস
- বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য নীতিনির্ধারণ
এর ফলে, অনেক দেশ বিদেশি কোম্পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং স্থানীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতের ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে নয়া-উদারবাদী নীতির প্রবর্তন ঘটে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি উদার হলেও সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান সংকট বেড়েছে।
নয়া-উদারবাদের সমালোচনা:
- আর্থ-সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি
- কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিলুপ্তি
- রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হ্রাস
- পরিবেশগত অবনতি
- গণতন্ত্রের উপর চাপ
উপসংহার:
রাষ্ট্রের নয়া-উদারবাদী তত্ত্ব একটি নির্দিষ্ট ধরণের রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন, যেখানে রাষ্ট্র কেবলমাত্র বাজারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। এই তত্ত্ব উন্নয়নের এক নতুন মডেল উপস্থাপন করলেও, এর ফলে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অসমতা সৃষ্টি হয়েছে, তা বর্তমান সময়ে এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সমসাময়িক রাষ্ট্রচিন্তায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ মডেল—যেখানে বাজার ও রাষ্ট্র উভয়ই সামাজিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে—তা অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
Unit–4: নব্য-মার্কসীয় ধারণা: দ্বন্দ্ববাদ, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।
*****3) প্রশ্ন. কোন কোন দিক থেকে রাজনীতি বিশ্লেষণের মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গিগুলির থেকে স্বতন্ত্র? 5/10
রাজনীতির অধ্যয়নে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি
রাজনীতির অধ্যয়নে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হল মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি কার্ল মার্ক্স ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের রচনার উপর ভিত্তি করে গঠিত এবং এটি রাজনৈতিক ঘটনাবলিকে শ্রেণি, উৎপাদন ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করে। মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গির থেকে যে সকল দিক থেকে স্বতন্ত্র, তা নীচে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
-
অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর জোর (Economic Determinism):
মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো অর্থনৈতিক ভিত্তিকে প্রাধান্য দেওয়া। মার্ক্স মনে করতেন সমাজের মৌল কাঠামো অর্থনৈতিক এবং রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, আইন ইত্যাদি হলো তার উপর নির্ভরশীল "উপরিকাঠামো" (superstructure)।
অন্য দৃষ্টিভঙ্গিগুলি যেমন উদারতান্ত্রিক বা প্রতিষ্ঠানবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতিকে স্বাধীন বা নিরপেক্ষ ক্ষেত্র বলে মনে করে, সেখানে মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতিকে অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রকাশ হিসেবে ব্যাখ্যা করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে যে শ্রেণি অর্থনৈতিকভাবে শাসন করে, তারাই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে রাখে।
-
শ্রেণি সংগ্রামের বিশ্লেষণ (Class Struggle):
মার্ক্সের মতে, ইতিহাসের অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি হল শ্রেণি সংগ্রাম। প্রাচীন যুগে মনিব ও দাস, মধ্যযুগে সামন্ত ও কৃষক, আর আধুনিক যুগে পুঁজিপতি (বুর্জোয়া) ও মজুর (প্রলেতারিয়েত) — এই দ্বন্দ্ব রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গি যেমন উদারতান্ত্রিক বা গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, নির্বাচন বা সাংবিধানিক কাঠামোর উপর গুরুত্ব দিলেও মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি শ্রেণি-বৈষম্য এবং তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দ্বন্দ্বকেই মুখ্য মনে করে।
-
রাজনীতিকে শ্রেণি আধিপত্যের মাধ্যম হিসেবে দেখা:
মার্ক্সীয় বিশ্লেষণে রাষ্ট্র ও রাজনীতি হলো শাসক শ্রেণির হাতিয়ার। রাষ্ট্র নিরপেক্ষ নয়, বরং এটি সেই যন্ত্র যা শাসক শ্রেণির অর্থনৈতিক আধিপত্যকে বজায় রাখতে সাহায্য করে। মার্ক্স লিখেছিলেন, "The executive of the modern state is but a committee for managing the common affairs of the whole bourgeoisie."
অন্যদিকে, উদারতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক মতবাদ রাষ্ট্রকে নাগরিকদের অধিকার রক্ষাকারী বা একটি নিরপেক্ষ সমন্বয়কারী শক্তি হিসেবে দেখে।
-
বিপ্লব ও সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে রাজনীতির বিশ্লেষণ:
মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি স্বতন্ত্র দিক হলো এটি শুধুমাত্র রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করেই ক্ষান্ত নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে রাজনীতির ব্যাখ্যা দেয়। মার্ক্সের মতে, দার্শনিকরা কেবলমাত্র বিশ্বকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু বাস্তব কাজ হলো একে পরিবর্তন করা।
এই কারণে মার্ক্সীয় চিন্তাধারা অনেক সময় "প্রাক্সিস" বা কাজ ও চিন্তার সংযুক্তিকে গুরুত্ব দেয়, যা অন্যান্য তাত্ত্বিক বা বর্ণনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় অধিক কার্যকেন্দ্রিক।
-
ধারণাগত বিশ্লেষণের পরিবর্তে বস্তুগত বিশ্লেষণ (Materialist Conception of History):
মার্ক্স ইতিহাসকে বস্তুগত ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করেন, যা "ঐতিহাসিক বস্তুবাদ" নামে পরিচিত। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, উৎপাদনের পদ্ধতি ও উৎপাদন সম্পর্কই ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করে।
অন্যান্য রাজনৈতিক বিশ্লেষণ পদ্ধতিগুলি যেমন আদর্শ, সংস্কৃতি, ব্যক্তিত্ব বা সংবিধানকে কেন্দ্র করে রাজনীতির ব্যাখ্যা দেয়, তেমনটি মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ করে না। এটি আরও গভীরে গিয়ে সেই অর্থনৈতিক কাঠামোকে চিহ্নিত করে, যার উপর রাজনৈতিক আদর্শ গড়ে ওঠে।
-
ইডিওলজি বা মতাদর্শের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ:
মার্ক্সীয় চিন্তায় 'ইডিওলজি' বা মতাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মার্ক্সের মতে, শাসক শ্রেণির ধারণাগুলিই সমাজে "প্রচলিত" বা "বাধ্যতামূলক" ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মতাদর্শ হলো এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে সমাজের বাস্তব শ্রেণিগত বৈষম্য আড়াল করা হয়।
এই সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি মার্ক্সীয় বিশ্লেষণকে বিশেষভাবে প্রভাবশালী করে তোলে, যা ক্ষমতা ও সত্যের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলে — অন্য দৃষ্টিভঙ্গিগুলি যেটি তুলনামূলকভাবে এড়িয়ে যায়।
-
উৎপাদন ও শ্রমের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ:
মার্ক্সীয় রাজনীতি বিশ্লেষণে শ্রম ও উৎপাদনের প্রক্রিয়া একটি কেন্দ্রীয় স্থান দখল করে। শ্রমিকশ্রেণির শোষণ, পণ্যের মূল্য নির্ধারণ, উদ্বৃত্ত মূল্য (surplus value) এবং মূলধনের সঞ্চয় প্রক্রিয়া — এই সবকিছুই রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্রীয় উৎস হিসেবে ধরা হয়।
এই বিশ্লেষণ অন্যান্য রাজনীতি দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুপস্থিত বা গৌণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
-
গ্লোবাল বা আন্তর্জাতিক মাত্রা:
মার্ক্সীয় রাজনীতির বিশ্লেষণ কেবল একটি রাষ্ট্র বা সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রেণি-সম্পর্ক ও পুঁজিবাদের বিস্তারকে বোঝার চেষ্টা করে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বৈশ্বিক পুঁজির আধিপত্য মার্ক্সীয় চিন্তায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে।
উপসংহার: রাজনীতি বিশ্লেষণের মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গিগুলির থেকে বহুমাত্রিকভাবে স্বতন্ত্র। এটি রাজনীতিকে একটি নিরপেক্ষ ক্ষেত্র হিসেবে দেখে না, বরং এটি শ্রেণি আধিপত্য, উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ার হিসেবে বিশ্লেষণ করে। মার্ক্সীয় চিন্তা কেবল রাজনৈতিক ঘটনাকে বোঝার চেষ্টা করে না, বরং সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি কার্যকর তাত্ত্বিক মডেল সরবরাহ করে।
তাই রাজনৈতিক বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ একটি অপরিহার্য ও সমালোচনামূলক পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত — যা সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত শক্তি সম্পর্ক, শ্রেণি দ্বন্দ্ব ও শোষণকে অনাবৃত করে।
Unit–6: গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা; দল সম্পর্কে বিতর্ক:
*****4) প্রশ্ন. লেনিনের বিপ্লব তত্ত্ব সম্পর্কে একটি টীকা লেখ। (১০ নম্বর)
ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন রুশ বিপ্লবের নেতা এবং মার্কসবাদী তত্ত্বের একজন মহান পুরোধা। লেনিন তার তত্ত্বের মাধ্যমে রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ পরিক্রমা নির্ধারণ করেন। লেনিনের বিপ্লব তত্ত্ব বা লেনিনিজম মূলত মার্কসবাদী তত্ত্বের একটি উন্নত ও প্রাসঙ্গিক রূপ যা পরবর্তীকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে।
১. মার্কসবাদ ও লেনিনিজমের পার্থক্য: মার্কসবাদে যে বিপ্লবের ধারণা ছিল, তা ছিল একটি প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক এবং সর্বজনীন প্রক্রিয়া। মার্কসের মতে, সমাজের শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে পুঁজিবাদী শোষণের অবসান ঘটবে এবং এই সংগ্রাম পূর্বে উন্নত শিল্পীভূত দেশগুলোতে ঘটবে। তবে লেনিন এই তত্ত্বে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী ও সংযোজন করেন, বিশেষ করে 'প্রাক-বিপ্লবী' অবস্থার বিশ্লেষণ ও বিপ্লবী সংগঠনের ভূমিকা সম্পর্কে।
লেনিনের মতে, পুঁজিবাদী শোষণের অবসান ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা রুশ মতো একটি পিছিয়ে থাকা দেশেও সম্ভব, যদি সেখানে একটি শক্তিশালী বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব থাকে। মার্কস যে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে একেবারে প্রাকৃতিক মনে করেছিলেন, লেনিন তা বিপ্লবী দলের কার্যক্রম ও উদ্যোগের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিলেন।
২. লেনিনের বিপ্লব তত্ত্বের মূল ভিত্তি:
ক. বিপ্লবী দলের গুরুত্ব: লেনিন বিশ্বাস করতেন যে, শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে বিপ্লবের প্রতি সচেতনতা সৃষ্টি এবং বিপ্লবী আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য একটি বিশেষ বিপ্লবী দলের প্রয়োজন। এই দলটি হবে পেশাদার বিপ্লবী, যারা শ্রেণী সংগ্রামকে সঠিকভাবে পরিচালনা করবে। তিনি শ্রমিকদের মধ্যে বিপ্লবের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য "অগ্রণী দল" বা "ভঙ্গী দলের" ভূমিকা নিয়েছিলেন। এই দলের কাজ ছিল শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষা ও সংগঠন গড়ে তোলা এবং শ্রমিক শ্রেণীকে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করা।
খ. পুঁজিবাদী শাসনের পতন: লেনিনের মতে, পুঁজিবাদী শাসন একসময় তার আভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে পতিত হবে এবং তখনই বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, পুঁজিবাদী শোষণ এবং সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে তা একদিন মানুষকে বিদ্রোহী করে তুলবে। এই বিদ্রোহী মনোভাবকে পরিচালনা করতে একটি সংগঠিত বিপ্লবী দল অপরিহার্য।
গ. দেশী বিপ্লব ও আন্তর্জাতিক বিপ্লব: লেনিনের মতে, একটি একক দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সঠিকভাবে সম্ভব নয়, যতক্ষণ না তা আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত না হয়। তবে তার একটি বিশেষ দৃষ্টি ছিল যে, প্রথমে একটি দেশের ভিতরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানো উচিত এবং পরবর্তীতে তা আন্তর্জাতিক বিপ্লবের পথে প্রভাব ফেলবে। তিনি "যুদ্ধের পরবর্তী বিশ্ব বিপ্লব" ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন, যেখানে একক একটি দেশের বিপ্লব গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
৩. লেনিনের মতবাদে নেতৃত্বের ভূমিকা: লেনিনের বিপ্লবী তত্ত্বে নেতৃত্বের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেখান, যে কোন বিপ্লব সফল হতে হলে তার নেতৃত্বে একটি অভিজ্ঞ, শিক্ষিত এবং সংগঠিত দল প্রয়োজন। এই দলটি শ্রমিকদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে এবং তাদের মধ্যে বিপ্লবী মনোভাব গড়ে তুলবে। লেনিন তার তত্ত্বে বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের সাফল্য সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং বিশেষ করে রাশিয়ার মতো একটি কৃষিপ্রধান দেশে, যেখানকার শ্রমিক শ্রেণী নিতান্তই অল্পসংখ্যক, সেখানে একটি বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা তুলে ধরেন।
৪. রুশ বিপ্লবের কার্যকরী দিক: লেনিনের বিপ্লব তত্ত্ব মূলত রুশ সমাজে প্রয়োগের মাধ্যমে সফল হয়েছিল। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবে, লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে এবং রুশ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এর মাধ্যমে তিনি তার তত্ত্বের কার্যকারিতা প্রমাণ করেন এবং সেই সাথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নতুন দিশা দেখান।
৫. লেনিনের বিপ্লব তত্ত্বের প্রভাব: লেনিনের বিপ্লব তত্ত্বের প্রভাব শুধু রাশিয়াতে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছে। তাঁর তত্ত্বের মাধ্যমে অন্যান্য দেশের শ্রমিক শ্রেণীও তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও সংগ্রামকে শক্তিশালী করে তোলে।
বিশেষভাবে, লেনিনের তত্ত্বের পরবর্তী কালে চীনে, কিউবায় এবং অন্যান্য দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। তাঁর বিপ্লব তত্ত্বে মার্কসবাদী ধারণার পুনঃপর্যালোচনা এবং আধুনিকীকরণ বিশ্ব বিপ্লবের জন্য একটি নতুন দৃষ্টিকোণ তৈরি করে।
৬. সমালোচনা: লেনিনের বিপ্লব তত্ত্বের কিছু সমালোচনাও রয়েছে। তার তত্ত্বের মধ্যে অগণতান্ত্রিক মনোভাব এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে, লেনিনের নেতৃত্বে যে কঠোর শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা অনেকের কাছে "একদলীয় শাসন" এবং "স্বৈরাচার" হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এছাড়া, শ্রমিকদের মুক্তির প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে নেতাদের অত্যাধিক ক্ষমতা তার সমালোচকদের জন্য এক বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
উপসংহার: লেনিনের বিপ্লব তত্ত্ব, মার্কসবাদী তত্ত্বের একটি উন্নত রূপ হিসেবে, ২০ শতকের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং বিপ্লবগুলির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করে। তার বিপ্লবী দৃষ্টিকোণ, সংগঠন এবং নেতৃত্বের ধারণা আজও অনেক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে প্রাসঙ্গিক এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। তবে, তার তত্ত্বের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে অনেক বিতর্ক ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা এখনও অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণের বিষয়।