Kalyani University Suggestion
Kalyani University B.A 3rd Semester History Minor Nep Suggestions 2026
মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস / History of Medieval India
Kalyani University B.A 3rd Semester History Minor Nep ছোট প্রশ্ন, বড়ো প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন PDF টি পেতে.. তুমি 99 টাকা পেমেন্ট কর। পেমেন্টের পর এক সেকেন্ডের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাজেশনটি পাবে। ধন্যবাদ। টাকা টি পেমেন্ট করার জন্য নিচে PAY বাটনে ক্লিক কর।
তুমি চাইলে সরাসরি PhonePe-এর মাধ্যমে 99 টাকা পেমেন্ট করে সাজেশন সংগ্রহ করতে পার। PhonePe নম্বর: 6295668424 (পেমেন্টের পর স্ক্রিনশট হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালে PDF COPY পাঠিয়ে দেব।)
My Phone Number- 6295668424
সম্পূর্ণ সাজেশন টি ইউটিউবে দেখানো হয়েছে তুমি দেখে আসতে পারো।
• এই সাজেশনের বড়ো প্রশ্ন সংখ্যা 28 টি।
ছোট প্রশ্ন প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন পাবেন।
• নিরক্ষরেখে বলতে পারি এই সাজেশনেরর বাইরে কোন প্রশ্ন উত্তর আসবে না।
• ১০০% তোমরা কমন পাবে।
• এই সাজেশনের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সিলেবাস অনুযায়ী এবং ইউনিট
অনুযায়ী সাজানো রয়েছে ।
• তোমরা চাইলে খুব সহজে BUY করতে পারো।
• THANK YOU.
এখানে অল্প কিছু প্রশ্নোত্তর আপলোড করা হয়েছে যদি তোমার মনে হয় সাজেশনটি BUY করতে পারো ।
(সিলেবাস – ২০২৫)
Unit–1: সুলতানি শাসনের অধীনে উত্তর ভারত (১২০৬–১২৮৬ খ্রিঃ) — সুলতানি সাম্রাজ্যের বিস্তার, খলজি বিপ্লব ও খলজি সাম্রাজ্যের উত্থান; তুঘলক শাসনের সংস্কার ও পাল্টা সংস্কার; বিজয়নগর, বাহমনি ও বাংলার উত্থান; সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন; সমাজ, অর্থনীতি, শিল্পকলা, স্থাপত্য ও সাহিত্য।
Unit–2: মুঘলদের উত্থানের প্রেক্ষাপট — দিল্লিতে তৈমুরের আক্রমণ, সৈয়দ ও লোদিদের শাসন; বাবরের ভারত আক্রমণ ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ; হুমায়ুনের ব্যর্থতা; শেরশাহের শাসন ও আফগান প্রশাসন; পরবর্তী মুঘল সাম্রাজ্য: আকবর থেকে ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত রাষ্ট্র নির্মাণ।
Unit–3: জায়গির সংকট ও কৃষি সংকট; মুঘল সাম্রাজ্যের পতন; আঞ্চলিক রাজনীতির বিকাশ; শিবাজির নেতৃত্বে মহারাষ্ট্র ও পেশোয়া প্রশাসন; বাংলা, অযোধ্যা, মহীশূর ও হায়দরাবাদের রাষ্ট্রসমূহের উত্থান।
Unit–4: মুঘল সাম্রাজ্যের সামগ্রিক মূল্যায়ন — রাষ্ট্র ও ধর্ম, প্রশাসনিক কাঠামোর মূল্যায়ন; মনসবদারি ও জায়গির ব্যবস্থা; ভূমি ও কৃষি ব্যবস্থাপনা; শহরের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য; ব্যবসা ও শিল্প; সমাজ ও সংস্কৃতি; জনসাধারণের ধর্মচর্চা; ভাষা, সংগীত, সাহিত্য, শিল্পকলা ও স্থাপত্যের বিকাশ।
Unit–1: সুলতানি শাসনের অধীনে উত্তর ভারত
*****1) প্রশ্ন. বাজারদর নিয়ন্ত্রণে আলাউদ্দিন খিলজি কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন? ১০/৫
ভূমিকা:
ভারতের মধ্যযুগীয় ইতিহাসে দিল্লি সালতানাতের শাসকদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী শাসক ছিলেন আলাউদ্দিন খিলজি (শাসনকাল: ১২৯৬–১৩১৬ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি খিলজি বংশের দ্বিতীয় সুলতান হিসেবে কেবল যুদ্ধজয়ী সেনাপতি নন, বরং এক দক্ষ প্রশাসক ও সমাজসংস্কারক হিসেবেও পরিচিত। তাঁর শাসনামলে রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। আলাউদ্দিন খিলজির বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল সাধারণ জনগণের কল্যাণ সাধন, সেনাবাহিনীর জন্য সুলভ মূল্যে রসদের ব্যবস্থা করা, এবং মজুতদার ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের দমন করা। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হন, অন্যদিকে সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাও নিশ্চিত করেন।
আলাউদ্দিন খিলজির বাজার নিয়ন্ত্রণের পটভূমি: সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির শাসনকাল ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বহির্শত্রুর হুমকিতে পরিপূর্ণ। মোঙ্গলদের একের পর এক আক্রমণ, রাজ্যজয়ের ধারাবাহিকতা এবং বিশাল সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন ছিল। সেই অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে সাধারণ জনগণের ওপর বোঝা না চাপিয়ে অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা আনার এক দুরূহ কাজ তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করেন। এই প্রেক্ষাপটে তিনি বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
১. মূল্যনির্ধারণ: আলাউদ্দিন খলজি বাজারদরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রথমত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেন। তিনি চাল, গম, ডাল, চিনি, ঘি, মাংস, কাপড়, এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের নির্ধারিত দাম বেঁধে দেন। এই মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে তিনি ব্যবসায়ীদের অনৈতিক মুনাফা অর্জনের সুযোগ কমিয়ে আনতে সক্ষম হন। সুলতান নিজে এই মূল্যের উপর কড়া নজরদারি করতেন যাতে কোনো ব্যবসায়ী নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে না পারে। সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
উদাহরণস্বরূপ:
- চাল প্রতি মণ ৭২ দাম
- গম প্রতি মণ ৫১ দাম
- ঘি প্রতি সের ২ দাম
- রেশমের কাপড় প্রতি গজ ১০ দাম
এই নির্ধারিত মূল্যের বাইরে পণ্য বিক্রয় করলে কঠোর শাস্তির বিধান ছিল। এই পদক্ষেপ মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য রোধে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়।
২. গুদাম এবং বিতরণ ব্যবস্থা: আলাউদ্দিন খলজি বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য গুদাম এবং বিতরণ ব্যবস্থা স্থাপন করেন। দিল্লিতে তিনি একটি কেন্দ্রিয় গুদাম স্থাপন করেন যেখানে সমস্ত পণ্য মজুদ করা হতো এবং সেখান থেকে তা বিতরণ করা হতো। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি পণ্যের অভাব এবং মূল্য বৃদ্ধির সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হন।
৩. নজরদারি এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা: বাজারদর নিয়ন্ত্রণে আলাউদ্দিন খলজি কঠোর নজরদারি এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি বাজারে নিয়মিত গোয়েন্দা পাঠাতেন যারা বাজারের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন এবং কোনো ব্যবসায়ী নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। এই শাস্তির মধ্যে জরিমানা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং প্রয়োজনে কারাদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল।
৪. মজুতদারি নিষিদ্ধ: আলাউদ্দিন খলজি মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ব্যবসায়ীরা যাতে পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে, সে জন্য সুলতান মজুতদারি নিষিদ্ধ করেন। যদি কোনো ব্যবসায়ী মজুতদারির সাথে জড়িত থাকত, তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো।
৫. পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন: আলাউদ্দিন খলজি পণ্য পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নেও মনোনিবেশ করেন। তিনি সড়ক এবং পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়ন করেন যাতে পণ্য দ্রুত এবং নিরাপদে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছাতে পারে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করেন এবং বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখেন।
৬. রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার: বাজারদর নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আলাউদ্দিন খলজি রাজস্ব ব্যবস্থারও সংস্কার করেন। তিনি কর আদায়ের পদ্ধতি সহজ এবং কার্যকর করেন যাতে কৃষক এবং সাধারণ জনগণের উপর করের বোঝা কমে। রাজস্ব ব্যবস্থার এই সংস্কারের ফলে কৃষকরা সুষ্ঠু পরিবেশে উৎপাদন কার্য চালাতে পেরেছেন এবং পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৭. সেনাবাহিনীর জন্য রেশনিং ব্যবস্থা: একটি বড় সেনাবাহিনীর রসদ জোগানো সহজ কাজ নয়। তাই আলাউদ্দিন সেনাদের জন্য আলাদা সরকারি রেশনিং ব্যবস্থা চালু করেন। বাজার থেকে না কিনে সরাসরি সরকারি গুদাম থেকে সেনারা রেশন পেত। এতে বাজারে চাপ কমে এবং পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকে।
৮. রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার: আলাউদ্দিন রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার করে কৃষিজ উৎপাদনের উপর নির্ভরতা বাড়ান এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমান। কৃষকেরা সরাসরি সরকারের অধীনে কর দিত, ফলে তারা লাভবান হতো এবং উৎপাদনও বেড়ে যায়। এর ফলে বাজারে পণ্যের জোগান বৃদ্ধি পায় এবং মূল্য স্থিতিশীল থাকে।
বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলাফল ও প্রভাব:
- পণ্যের দাম ছিল স্থির ও স্বল্প।
- মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
- মজুতদারি, চোরা বাজার, মূল্যবৃদ্ধি – এই সমস্যাগুলো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে।
- সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্য সরবরাহ ও রসদ জোগানে কোন অসুবিধা হয়নি।
- দিল্লি ও তার আশেপাশের অঞ্চলে বাজার ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আসে।
সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা: এই ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে সুলতানের ব্যক্তিগত নেতৃত্ব ও শক্তিশালী প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর এই ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তদ্ব্যতীত:
- কিছু ব্যবসায়ী ও ধনিকশ্রেণির মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
- বাজারে পণ্যের গুণমান নিয়ন্ত্রণ সবসময় সম্ভব হয়নি।
- দুর্নীতিপরায়ণ দপ্তর ও কিছু নজরদার কর্মকর্তার কারণে শাসনের স্বচ্ছতা অনেক সময় বজায় থাকত না।
উপসংহার: আলাউদ্দিন খিলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মধ্যযুগীয় ভারতীয় অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তাঁর এই ব্যবস্থা কেবলমাত্র বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করেই থেমে থাকেনি, বরং এটি ছিল একটি বৃহত্তর সমাজসংস্কারের অংশ। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দক্ষতা, সেনাবাহিনীর রসদ জোগান এবং জনগণের জীবনের মান উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হন।
তাঁর এই নীতি আজও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এক অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচিত হয়। কঠোর শাসন, দৃঢ় সিদ্ধান্ত এবং বাস্তবমুখী প্রশাসনিক দক্ষতার মেলবন্ধন যে কিভাবে একটি রাজ্যের অর্থনীতি ও সমাজকে স্থিতিশীল করতে পারে—আলাউদ্দিন খিলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
Unit–2: মুঘলদের উত্থানের প্রেক্ষাপট
*****2) প্রশ্ন.শেরশাহ শুধুমাত্র একজন উদ্ভাবক ছিলেন না। তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল সরকারী প্রশাসন যন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত ও দক্ষ করে তোলা - তুমি কি এই বক্তব্যের সাথে একমত? 5/10
ভূমিকা: ভারতের ইতিহাসে শেরশাহ সূরির নাম এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে। তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ শাসক, দক্ষ সংগঠক, এবং যুগান্তকারী সংস্কারক। তার শাসনকাল যদিও খুব স্বল্পস্থায়ী (১৫৪০-১৫৪৫), তবুও এই স্বল্প সময়ে তিনি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এমনসব পরিবর্তন সাধন করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট আকবর সহ আরও অনেক শাসক অনুসরণ করেছিলেন। এই কারণে ইতিহাসবিদদের অনেকেই মনে করেন যে শেরশাহ কেবল একজন উদ্ভাবক ছিলেন না, বরং তার গভীর উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক কাঠামোকে পুনরুজ্জীবিত করে এক কার্যকর ও জনমুখী সরকার গঠন করা।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব শেরশাহের শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন দিক, তার সংস্কারমূলক পদক্ষেপ, এবং তার প্রশাসনিক দক্ষতার মাধ্যমে এই বক্তব্যটির সপক্ষে যুক্তি খণ্ডন করব।
১. শেরশাহের প্রশাসনিক দক্ষতা ও উদ্দেশ্য: শেরশাহ একজন কৌশলী শাসক ছিলেন যিনি বুঝেছিলেন যে একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে সুদৃঢ় প্রশাসনিক ব্যবস্থা অপরিহার্য। তিনি কেন্দ্র ও প্রদেশীয় স্তরে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার লক্ষ্য ছিল এমন একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা, যা শুধু শৃঙ্খলা ও শাসনের জন্য নয়, বরং জনগণের কল্যাণ সাধনেও সহায়ক হবে। তিনি প্রশাসনকে শুধুমাত্র রাজস্ব আদায় বা সামরিক দিক থেকে দেখেননি, বরং এর সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন সামাজিক ন্যায়, জনসুরক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নকে।
২. রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার: শেরশাহের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও সুপরিচিত কাজ ছিল তার রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার। তিনি ভূমি জরিপের ভিত্তিতে কৃষিজমি শ্রেণিবিন্যাস করেন এবং প্রত্যেক জমির জন্য নির্দিষ্ট কর ধার্য করেন। প্রতি বিঘা জমির উপর ভিত্তি করে কর নির্ধারণ করা হয়, যা কৃষকদের জন্য ছিল সুনির্দিষ্ট ও পূর্বানুমেয়।
তিনটি মূল পদক্ষেপ ছিল:
- ভূমি জরিপ ও পরিমাপ (measurement and survey)
- ফসলভিত্তিক কর নির্ধারণ (crop-based revenue system)
- আগ্রিম কর সংগ্রহ নয়, বরং ফসল কাটার পরে আদায় (post-harvest collection)
এই ব্যবস্থায় দুর্নীতি কমে আসে, মধ্যস্থতাকারীর শোষণ হ্রাস পায় এবং কৃষকরা সরাসরি সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এটি নিশ্চিত করে যে শেরশাহের উদ্দেশ্য কেবল কর আদায় ছিল না, বরং কৃষকদের ওপর শোষণ কমিয়ে কার্যকর শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
৩. মুদ্রানীতি ও অর্থনৈতিক সংস্কার: শেরশাহের মুদ্রানীতি প্রশাসনিক দক্ষতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি রূপার মুদ্রা "রুপি" চালু করেন, যা পরবর্তীতে সমগ্র ভারতবর্ষে একটি মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। তামা ও সোনার মুদ্রাও প্রচলন করেন। তার এই মুদ্রানীতি ভারসাম্যপূর্ণ ছিল এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে উৎসাহিত করেছিল। একজন উদ্ভাবকের তুলনায়, একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবেই তিনি মুদ্রানীতিকে এমনভাবে পরিচালনা করেন যাতে দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য সহজতর হয়। এর ফলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে এবং জনগণের ওপর বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
৪. যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সড়ক নির্মাণ: শেরশাহের শাসনামলে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। তিনি বিখ্যাত "সড়ক-ই-আজম" (Grand Trunk Road) নির্মাণ করেন, যা বাংলার সোনারগাঁও থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই রাস্তায় নির্দিষ্ট দূরত্বে সারাই (সরাইখানা) তৈরি করা হয়, যেখানে যাত্রীদের থাকার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা ছিল। এছাড়াও প্রতিটি সরাইখানায় ডাকঘর, অশ্বারোহী ডাকপিয়ন, এবং প্রহরী নিযুক্ত থাকতো। এর ফলে কেবল যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নই ঘটেনি, বরং প্রশাসনের নজরদারি, বিচার ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সামরিক কার্যক্রম অনেক বেশি কার্যকর হয়।
৫. বিচারব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা: শেরশাহ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি বিচারব্যবস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা করেছিলেন। হিন্দুদের জন্য হিন্দু বিচারক ও মুসলিমদের জন্য কাজি নিয়োগ করেন। তিনি চুরি-ডাকাতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, এবং কোথাও যদি ডাকাতি হতো, সেখানকার স্থানীয় প্রশাসককে দায়ী করা হতো। এটি প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও সততার অনন্য দৃষ্টান্ত।
৬. সামরিক ও কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা: শেরশাহ তার সামরিক বাহিনীকে সংগঠিত করেন মুঘলদের মতো নয়, বরং তিনি নিজেই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। সৈন্যদের নাম, অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়ার সংখ্যা—সব কিছু রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ রাখা হতো। এটি ছিল মেরিট ভিত্তিক নিয়োগের এক নিদর্শন। তিনি দাগ এবং হাজিরা পদ্ধতি চালু করেন, যার ফলে সেনা প্রশাসনে দুর্নীতির পরিমাণ কমে যায়। এছাড়া প্রতিটি প্রদেশে শক্তিশালী প্রশাসক নিযুক্ত করেন যারা সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন ছিলেন।
৭. ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সমাজনীতি: যদিও তিনি ছিলেন একজন মুসলিম শাসক, কিন্তু শেরশাহ ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বজায় রেখেছিলেন। হিন্দু মন্দির ধ্বংস না করে তিনি হিন্দুদের ওপর কোনও অতিরিক্ত কর আরোপ করেননি। বরং হিন্দু ভূস্বামীদের থেকে রাজস্ব আদায়ে তিনি তাদের সম্মান বজায় রেখে চলেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে শেরশাহ একজন উদ্ভাবক বা কেবল ক্ষমতালোভী শাসক ছিলেন না, বরং সমাজের সকল শ্রেণির মধ্যে ভারসাম্য রেখে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করেছিলেন।
৮. জনগণের কল্যাণমুখী শাসন: শেরশাহের বিভিন্ন পদক্ষেপ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তার শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল প্রজাদের মঙ্গল। তিনি সরাইখানা, কূপ, সড়ক নির্মাণ, ডাক ব্যবস্থার উন্নয়ন, সুশৃঙ্খল প্রশাসন ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের জীবনে স্বস্তি ও সুরক্ষা এনে দেন। এইসব পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি একজন সুদূরদর্শী প্রশাসক হিসেবে প্রমাণ রেখেছেন, যিনি তার শাসনকালে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
উপসংহার: সব দিক বিচার করে বলা যায়, শেরশাহ সূরি নিঃসন্দেহে একজন উদ্ভাবক ছিলেন, কিন্তু তার উদ্ভাবনের পেছনে ছিল গভীর প্রশাসনিক বোধ ও দক্ষতা। তিনি শুধু নতুন কিছু আবিষ্কার করেই থেমে যাননি, বরং সেই আবিষ্কারগুলিকে রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ, কার্যকর, জনমুখী এবং স্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গঠন, যার মাধ্যমে রাজ্য পরিচালনা যেমন সহজ হয়, তেমনি জনগণও উপকৃত হয়। এই কারণেই বলা যায়, তিনি কেবল উদ্ভাবক নন, বরং প্রশাসনিক যন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত ও দক্ষ করার এক মহান পরিকল্পক ছিলেন।
অতএব, প্রশ্নে উল্লিখিত বক্তব্যের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত।
Unit–3 জায়গির সংকট, মুঘল পতন, আঞ্চলিক উত্থান।
*****৩) প্রশ্ন. জায়গিরদারি সংকট বলতে কী বোঝায়? অথবা, জায়গিরদারি সংকট মুঘল সাম্রাজ্যের উপর কতটা প্রভাব ফেলেছিল? (৫ নম্বর, ২০২৩)
ভূমিকা: মুঘল সাম্রাজ্য ভারতের ইতিহাসে এক বিশাল ও সুদৃঢ় সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত। প্রশাসনিক কাঠামোর ভিত মজবুত করতে এবং সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে মুঘল সম্রাটরা একটি বিশেষ জমি-বণ্টন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যাকে বলা হয় জায়গিরদারি প্রথা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যবস্থায় নানা অসংগতি, সংকট ও সমস্যার উদ্ভব ঘটে, যা পরে মুঘল প্রশাসন ও সাম্রাজ্যের জন্য মারাত্মক পরিণতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্যাকেই ইতিহাসে 'জায়গিরদারি সংকট' নামে অভিহিত করা হয়।
জায়গিরদারি প্রথা কী? 'জায়গির' শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো—একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা জমি, যার আয় থেকে একজন ব্যক্তি তার বেতন বা জীবিকা নির্বাহ করবেন। মুঘল সাম্রাজ্যে এই প্রথা ছিল একধরনের রাজস্ব আদায়ের ও পুরস্কার প্রদানের মাধ্যম। একজন সামরিক কর্মকর্তা বা আমলাকে তার প্রশাসনিক ও সামরিক দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে এক বা একাধিক অঞ্চল প্রদান করা হতো, যার রাজস্ব আদায়ের অধিকার তিনি পেতেন। এই জমির উপর তাঁরা সরাসরি মালিকানা পেতেন না, বরং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যবহার ও আয় তোলার অধিকার লাভ করতেন। এর ফলে সম্রাটের ওপর সরাসরি ব্যয় না বাড়িয়ে প্রশাসনিক ও সামরিক কাঠামো বজায় রাখা যেত।
জায়গিরদারি সংকট বলতে কী বোঝায়? ‘জায়গিরদারি সংকট’ বলতে বোঝানো হয় সেই সময়কে, যখন মুঘল সাম্রাজ্যে জায়গিরের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে এক বিরাট অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। নতুন নবাব, সেনানায়ক, আমির, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিযুক্ত হচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁদের জন্য উপযুক্ত জায়গির বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এই কারণে একদিকে উচ্চপদস্থ আমলারা বেতনবঞ্চিত হচ্ছিলেন, অন্যদিকে পুরনো জায়গিরদারদের জায়গির বাতিল করতে গিয়ে বিরোধ তৈরি হচ্ছিল। এই পরিস্থিতি ক্রমাগত চাপে ফেলে মুঘল প্রশাসনকে, যার ফলে সাম্রাজ্যের ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়ে।
জায়গিরদারি সংকটের কারণসমূহ: জায়গিরদারি সংকট উদ্ভবের পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল:
১. প্রশাসনিক বিস্তার ও কর্মকর্তা বৃদ্ধি: সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার দক্ষিণভারত পর্যন্ত পৌঁছায়। ফলে প্রশাসনের জন্য অধিক সংখ্যক আমলা ও সেনানায়ক নিয়োগ করা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত নতুন জমি বা আয়তন না থাকায় তাঁদের জন্য উপযুক্ত জায়গির বরাদ্দ করা সম্ভব হয়নি।
২. জায়গিরের সীমাবদ্ধতা: সাম্রাজ্যের আয়তন যতই বড় হোক না কেন, জায়গিরযোগ্য জমির একটি সীমা ছিল। অনেক সময় উর্বর বা আয়বর্ধক অঞ্চলের অভাব দেখা দেয়। এই সমস্যায় জায়গিরদাররা কম রাজস্বসক্ষম এলাকা পেয়ে অসন্তুষ্ট হতেন।
৩. কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ: জায়গিরদাররা প্রদেশে রাজস্ব আদায় করতেন, কিন্তু সেই অঞ্চলের প্রশাসনিক দায়িত্ব থাকত সুবাদার বা গভর্নরের হাতে। এই দ্বৈত কর্তৃত্বের ফলে সংঘর্ষ তৈরি হত, প্রশাসনিক দুর্বলতা তৈরি হতো।
৪. উত্তরাধিকার ও স্থানান্তর সমস্যা: জায়গির একজীবনের জন্য বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবে অনেক সময় পরিবার বা উত্তরসূরি সেটিকে ধরে রাখতে চাইত। এতে করে নতুন কর্মকর্তাদের জায়গির বরাদ্দে সমস্যা দেখা দিত।
৫. দুর্নীতি ও লুটপাট: জায়গিরদাররা কম সময়ের জন্য জায়গির পেতেন, ফলে অধিক লাভের আশায় তাঁরা দুর্নীতির আশ্রয় নিতেন, কৃষকদের উপর চরম শোষণ করতেন। এর ফলে কৃষি উৎপাদন ও রাজস্ব সংগ্রহে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়।
জায়গিরদারি সংকটের ফলাফল ও প্রভাব মুঘল সাম্রাজ্যের উপর:
১. প্রশাসনিক অকার্যকারিতা: যখন কর্মকর্তারা জায়গির পাচ্ছিলেন না, তখন তাদের মনোবল ভেঙে পড়ছিল। ফলে প্রশাসনিক কার্যকারিতা কমে যাচ্ছিল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সমস্যা দেখা দিচ্ছিল।
২. সামরিক দুর্বলতা: জায়গিরপ্রাপ্তি মুঘল সামরিক কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। সৈন্যদের রক্ষণাবেক্ষণ ও বেতন এই জায়গির থেকেই আসত। কিন্তু জায়গির সংকটে সৈন্যবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা হয় এবং মুঘল সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩. প্রাদেশিক বিদ্রোহ ও স্বায়ত্তশাসনের লক্ষণ: যেসব আমলা বা সুবাদার জায়গির নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন, তারা স্বশাসনের পথে হাঁটতে শুরু করেন। বাংলার নবাব, হায়দ্রাবাদের নিজাম, অউধের নবাব প্রভৃতি স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ করতে শুরু করেন।
৪. কৃষকদের উপর চাপ ও কৃষিক্ষেত্রে পতন: দুর্নীতিপরায়ণ জায়গিরদাররা কৃষকদের উপর চরম রাজস্ব চাপিয়ে দিতেন। কৃষকরা চাষাবাদ বন্ধ করে দিতেন বা পালিয়ে যেতেন। ফলে রাজস্ব আদায় কমে যায় এবং অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়।
৫. সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব দুর্বল হওয়া: সম্রাটের হাতে জায়গির বণ্টনের ক্ষমতা থাকলেও বাস্তবে সেই ক্ষমতা তলানিতে এসে পৌঁছায়। এতে সম্রাটের প্রতি আনুগত্য ও নিয়ন্ত্রণ ক্রমে ক্ষীণ হয়ে পড়ে। রাজ্যগুলো নিজস্ব স্বার্থে কাজ করতে থাকে।
ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ: ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র ও ইরফান হাবিবের মতে, জায়গিরদারি সংকট ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের ভিতরে গঠনতান্ত্রিক দুর্বলতার অন্যতম প্রতীক। তাঁদের মতে, এই সংকট ছিল শুধু প্রশাসনিক নয়, এটি ছিল একটি গভীর সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট, যা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
জায়গিরদারি সংকট এবং আওরঙ্গজেব: সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকালেই জায়গিরদারি সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারে যত বেশি মনোযোগ দেন, প্রশাসনিক ভারসাম্য রক্ষা ততটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। নতুন জায়গির বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত হওয়ায় তিনি একদিকে পুরনো জায়গির বাতিল করতে বাধ্য হন, অন্যদিকে রাজস্ব আদায়ে কঠোরতা দেখাতে থাকেন, যা আরও বিদ্রোহ ও ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
উপসংহার: সার্বিকভাবে বিচার করলে বলা যায়, জায়গিরদারি সংকট মুঘল সাম্রাজ্যের এক গভীর ও মারাত্মক দুর্বলতার প্রতিফলন। এটি শুধু একজন দুইজন কর্মকর্তার স্থানান্তরের সমস্যা ছিল না, বরং সমগ্র প্রশাসনিক কাঠামোর উপর এক স্থায়ী চাপ সৃষ্টি করেছিল। এই সংকট মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনীতি, প্রশাসন, সামরিক ক্ষমতা ও সামাজিক ভারসাম্যের উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। এই প্রথার দুর্বলতা, দুর্নীতি, অকার্যকারিতা ও অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের ঘণ্টাধ্বনি বাজতে শুরু করে। তাই ইতিহাসের পাতায় 'জায়গিরদারি সংকট' শুধু একটি প্রশাসনিক সমস্যা নয়, বরং এটি এক পূর্ণাঙ্গ সাম্রাজ্যিক সংকট হিসেবে বিবেচিত হয়।
Unit–4 মুঘল প্রশাসন, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি।
*****4) প্রশ্ন. শিবাজি প্রবর্তিত ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর। (১০ নম্বর)
ভূমিকা: ভারতের ইতিহাসে শিবাজি মহারাজ একজন গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবময় শাসক হিসেবে পরিচিত। ১৭শ শতকে মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি শুধু একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তোলেননি, বরং প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও নানা প্রগতিশীল ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা ছিল বিশেষভাবে উন্নত, সংগঠিত ও কৃষকবান্ধব। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে শিবাজি কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করেন এবং রাজকোষে নিরবিচারে রাজস্ব প্রবাহ নিশ্চিত করেন।
ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রেক্ষাপট: শিবাজির পূর্ববর্তী সময়ে দক্ষিণ ভারতে রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত বিশৃঙ্খল ও শোষণমূলক। মুঘল ও বিজয়নগর শাসনের ধারাবাহিকতায় অনেক জমিদার ও মধ্যস্থ ব্যক্তিরা কৃষকদের উপর অতিরিক্ত কর চাপিয়ে দেন। ফলে কৃষকসমাজ দুর্দশার মধ্যে পড়ে। এই সমস্যাগুলি দূর করতেই শিবাজি তাঁর শাসনামলে নতুন একটি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন, যা “রাজস্ব সংস্কার” নামে পরিচিত।
শিবাজির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. ভূমি জরিপ ও পরিমাপ: শিবাজি ভূমির প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করতে ‘মোজনি’ (Survey) চালু করেন। তাঁর আমলে জমির পরিমাপ করার জন্য ‘কারমিন’ (karmin) নামে নির্দিষ্ট আধিকারিক নিয়োগ করা হতো। জমির উর্বরতা, ধান উৎপাদনের পরিমাণ ও জমির প্রকৃতি অনুযায়ী তার শ্রেণিবিন্যাস করা হতো। জমির পরিমাপ ও শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তিতে রাজস্ব ধার্য করা হতো।
২. কৃষকের সরাসরি কর প্রদান: শিবাজি মধ্যস্থ ব্যক্তিদের (যেমন জমিদার, মহাজন) প্রভাব কমিয়ে কৃষকদের থেকে সরাসরি রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এর ফলে কৃষকদের উপর থেকে শোষণ কমে যায় এবং তাঁরা রাজশক্তির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হন। এই ব্যবস্থা কৃষকদের প্রতি তাঁর সদয় মনোভাবের প্রতিফলন।
৩. রাজস্বের হার নির্ধারণ: শিবাজি ফসলের গড় উৎপাদনের ভিত্তিতে ভূমি কর ধার্য করেন। রাজস্ব হার ছিল জমির উর্বরতা ও উৎপাদন অনুসারে ৩০% থেকে ৪০% এর মধ্যে। আগে এই হার ছিল প্রায় ৫০% বা তারও বেশি, যা শিবাজি কমিয়ে দেন। এর ফলে কৃষকেরা কিছু ফসল নিজেদের কাছে রাখতে পারতেন।
৪. স্থায়ী নথিভুক্তি ব্যবস্থা: ভূমি জরিপ ও রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য নথিভুক্ত করা হতো। কৃষকের নাম, জমির পরিমাণ, রাজস্বের পরিমাণ ইত্যাদি বিষয়ে একটি রেকর্ড রাখা হতো। এই তথ্য সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকতেন একজন ‘কুলকার্নি’ (Kulkarni) বা রাজস্ব লিপিকার। এতে ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ অনেক কমে যায়।
৫. পাট্টা ব্যবস্থা (Patta System): শিবাজির রাজস্ব ব্যবস্থায় প্রতিটি কৃষককে তার চাষের জমির একটি লিখিত কাগজ দেওয়া হতো, যাকে বলা হতো 'পাট্টা'। এতে জমির পরিমাণ, রাজস্বের পরিমাণ এবং মালিকের নাম উল্লেখ থাকতো। এটি একপ্রকার সরকারি স্বীকৃতি, যা কৃষকদের জমির উপর অধিকারের প্রমাণস্বরূপ কাজ করত।
৬. ফসল ও প্রকৃতি অনুসারে রাজস্ব: শিবাজির রাজস্ব ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। উর্বরতা, জলসেচের সুযোগ, আবহাওয়া, ফসলের ধরন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে রাজস্ব নির্ধারিত হতো। খরা, বন্যা বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে রাজস্ব মুকুব বা হ্রাস করা হতো। এভাবে শিবাজি কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।
৭. কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কাঠামো: শিবাজি রাজস্ব আদায়ের জন্য বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিতেন। গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন:
- মামলতদার (Mamlatdar): জেলা বা অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন।
- দেশমুখ (Deshmukh) ও দেশপান্ডে (Deshpande): স্থানীয় পর্যায়ে রাজস্ব আদায় ও রেকর্ড রাখার দায়িত্বে ছিলেন।
- কুলকার্নি (Kulkarni): রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্ত হিসাব রাখতেন।
এই কর্মকর্তারা রাজকোষে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজস্ব জমা দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ থাকতেন।
শিবাজির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার সুফল:
১. কৃষকদের স্বস্তি ও নিরাপত্তা: কৃষকদের উপর মধ্যস্থ শোষণের বোঝা কমে যায়। সরাসরি রাজস্ব প্রদান ও ন্যায্য কর হারের ফলে তারা চাষাবাদে মনোযোগী হতে পারেন।
২. রাজকোষে নিয়মিত রাজস্ব প্রবাহ: একটি সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত ব্যবস্থার ফলে শিবাজির রাজকোষ ছিল সমৃদ্ধ। এটি যুদ্ধ ও অন্যান্য প্রশাসনিক খরচ নির্বাহে সহায়তা করে।
৩. দুর্নীতি কমে যায়: সরাসরি রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা এবং লিখিত রেকর্ড রাখার ফলে দুর্নীতির সুযোগ কমে যায়। রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
৪. কৃষি উৎপাদনে উন্নতি: নিরাপত্তা ও স্বল্প করের ফলে কৃষকেরা বেশি জমি চাষ করতে উৎসাহী হন। এর ফলে সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
সমালোচনামূলক দিক: যদিও শিবাজির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা অনেকভাবে আধুনিক ও কৃষকবান্ধব ছিল, তবুও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল:
- অনেক অঞ্চলে রাজস্ব কর্মকর্তারা কৃষকদের থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করতেন।
- মাঝেমধ্যে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ বা কর মুকুব ঠিকভাবে কার্যকর হতো না।
- সর্বত্র এই ব্যবস্থা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি, বিশেষত নবদলিত অঞ্চলগুলোতে।
উপসংহার: শিবাজি প্রবর্তিত ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা তাঁর প্রশাসনিক দূরদর্শিতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম দৃষ্টান্ত। তিনি এই ব্যবস্থার মাধ্যমে একদিকে যেমন কৃষকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান করেছিলেন, অন্যদিকে রাজকোষকেও সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাঁর ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা মধ্যযুগীয় ভারতের অন্যতম প্রগতিশীল উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা পরবর্তী যুগে অনেক শাসকের অনুকরণীয় হয়ে ওঠে। ভারতীয় কৃষি অর্থনীতির ইতিহাসে শিবাজির এই ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয়।