Kalyani University B.A 4th Semester Bengli Major 401 Nep suggestions

Kalyani University Suggestion

Kalyani University B.A 4th Semester Bengali Major 401 Nep Suggestions 2025

মধ্যযুগের কাব্য ও কবিতা (পদ)

Course Code: BBNGMAJ02T

Kalyani University B.A 4th Semester Bengali Major 401 NEP ছোট প্রশ্ন, বড়ো প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন PDF টি পেতে.. আপনি 150 টাকা পেমেন্ট করুন। পেমেন্টের পর এক সেকেন্ডের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাজেশনটি পাবেন। ধন্যবাদ। টাকা টি পেমেন্ট করার জন্য নিচে PAY বাটনে ক্লিক করুন।

অথবা আপনি চাইলে সরাসরি PhonePe-এর মাধ্যমে 150 টাকা পেমেন্ট করে সাজেশন সংগ্রহ করতে পারেন। PhonePe নম্বর: 6295668424 (পেমেন্টের পর স্ক্রিনশট হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালে PDF COPY পাঠিয়ে দেব।)

My Phone Number- 6295668424

• এই সাজেশনের প্রশ্ন সংখ্যা 28 টি।
• নিরক্ষরেখে বলতে পারি এই সাজেশনেরর বাইরে কোন প্রশ্ন উত্তর আসবে না।
• ১০০% তোমরা কমন পাবে।
• এই সাজেশনের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সিলেবাস অনুযায়ী এবং ইউনিট অনুযায়ী সাজানো রয়েছে ।
• তোমরা চাইলে খুব সহজে BUY করতে পারো।
• THANK YOU.

এখানে অল্প কিছু প্রশ্নোত্তর আপলোড করা হয়েছে যদি তোমার মনে হয় সাজেশনটি BUY করতে পারো ।

মধ্যযুগের কাব্য ও কবিতা (পদ)

(সিলেবাস – ২০২৫)

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
(বিশেষ কাব্যসংকলন ও নির্বাচিত সাহিত্য পাঠ)
ক. বৈষ্ণব পদাবলী
পাঠ্যগ্রন্থ: কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত ‘বৈষ্ণব পদসংকলন’
অধ্যয়ন বিষয়: পর্ব, পদ ও কবিপ্রতিভা বিশ্লেষণ
নির্বাচিত পদসমূহ

১. “আজু হাম কি পেখলু নবদ্বীপচন্দ” — রাধামোহন ঠাকুর
২. “দাঁড়াইয়া নন্দের আগে” — বলরাম দাস
৩. “সই, কেবা শুনাইল শ্যামনাম” — চণ্ডীদাস
৪. “আলো মুঞি জানো না” — জ্ঞানদাস
৫. “মাধব, কি কহব” — গোবিন্দদাস
৬. “পিরীতি সুখের সায়র” — চণ্ডীদাস
৭. “চির চন্দন উরে” — বিদ্যাপতি
৮. “আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লু” — বিদ্যাপতি
৯. “তাতল সৈকত বারিবিন্দুসম” — বিদ্যাপতি
খ. কৃত্তিবাসী রামায়ণ
পাঠ্য অংশ: উত্তরকাণ্ড
গ. অন্নদামঙ্গল
রচয়িতা: ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর
ঘ. শাক্ত পদাবলী (নির্বাচিত পদ)
১. “গিরি, এবার আমার উমা এলে” — রামপ্রসাদ সেন
২. “আমি কি হেরিলাম নিশি স্বপনে” — কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
৩. “ওরে নবমী নিশি” — কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
৪. “যেয়ো না রজনী আজি লয়ে তারাদলে” — মধুসূদন দত্ত
৫. “শুকনো তরু মঞ্জুরে না” — কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
৬. “মা, আমায় ঘুরাবি কত” — রামপ্রসাদ সেন
৭. “দোষ কারো নয় গো মা” — দাশরথি রায়

ক. বৈষ্ণব পদাবলী

*****1) প্রশ্ন. :'আজু হাম কি পেখলু নবদ্বীপ চন্দ'—এই কবিতাটি কোন ভাষায় লেখা? এর ক্রিয়াপদগুলির বৈশিষ্ট্য কী? কার রচনা? কোন পর্যায়ের পদ? নবদ্বীপ চন্দ কে? কবি কেন উহাকে নবদ্বীপ চন্দ বলেছেন, তাঁর গূঢ়ার্থ সংক্ষেপে বলো।

ভূমিকা: বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে বৈষ্ণব পদাবলীর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। রাধা-কৃষ্ণের পারস্পরিক প্রেম ও ভক্তিমূলক অনুভূতি ঘিরেই এই সাহিত্যের মূল বিষয়বস্তু। বৈষ্ণব কবিগণ এই প্রেমময় লীলার মধ্য দিয়ে ভক্তির অদ্বিতীয় রূপ উপস্থাপন করেন। "আজু হাম কি পেখলু নবদ্বীপ চন্দ"—এই পংক্তিটি একটি বিখ্যাত বৈষ্ণব পদ, যার মধ্যে নিহিত আছে গভীর আধ্যাত্মিকতা, প্রেম, এবং কাব্যিক সৌন্দর্য।

এই কবিতাটি কোন ভাষায় লেখা?

এই পদটি ব্রজবুলি ভাষায় রচিত। ব্রজবুলি একটি কৃত্রিম ভাষা, যা মৈথিলী ও প্রাচীন বাংলার সংমিশ্রণে গঠিত। এই ভাষাটি বৈষ্ণব কবিরা রাধা-কৃষ্ণের লীলার আবেগ প্রকাশের জন্য ব্যবহার করতেন। ব্রজবুলিতে বাংলা ও হিন্দির মিলিত ধ্বনিরীতি থাকায় এটি এক বিশেষ কাব্যিক আবহ তৈরি করে।

কার রচনা?

এই বিখ্যাত পদটির রচয়িতা বসন্ত রায়। বসন্ত রায় মধ্যযুগের একজন প্রখ্যাত বৈষ্ণব কবি, যাঁর পদাবলীতে প্রেম, বিরহ, মিলন ও আধ্যাত্মিকতার অপূর্ব মিশ্রণ দেখা যায়। তিনি রাধার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কৃষ্ণপ্রেমের সূক্ষ্ম অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন।

কোন পর্যায়ের পদ?

এই পদটি বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যযুগীয় পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। এটি মূলত রাধার অভিসার ও মিলনকামী মানসিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটায়। এটি একটি রাগানুরাগমূলক অভিসারিক পদ, যেখানে রাধা তাঁর প্রিয় কৃষ্ণকে দর্শনের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করছেন।

ক্রিয়াপদগুলির বৈশিষ্ট্য কী?

এই পংক্তিতে ব্যবহৃত ক্রিয়াপদগুলি ব্রজবুলির বৈশিষ্ট্য বহন করে। যেমন:

• "পেখলু"—এই শব্দটি "দেখেছি" অর্থ প্রকাশ করে। এটি "পেখ" ধাতু থেকে এসেছে, যা মূলত হিন্দি বা মৈথিলী উৎসের।
• ব্রজবুলিতে ক্রিয়াপদগুলির রূপ বাংলার চলিত বা সাধু রীতি থেকে ভিন্ন। এখানে তৎসম শব্দের চেয়ে দেশজ ও প্রাকৃতিক শব্দ বেশি ব্যবহৃত হয়।
• এই ধরনের ক্রিয়াপদগুলি কাব্যিক ছন্দে সাবলীলভাবে মিশে যায় এবং ভাষাকে করে তোলে অধিক সংবেদনশীল ও নাটকীয়।

নবদ্বীপ চন্দ কে?

“নবদ্বীপ চন্দ” বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে কৃষ্ণকে। বৈষ্ণব পদাবলীতে কৃষ্ণকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়—যেমন শ্যাম, মাধব, কানু, চন্দ ইত্যাদি। এখানে "চন্দ" শব্দটি এসেছে "চন্দ্র" অর্থাৎ চাঁদের মত উজ্জ্বল, মাধুর্যপূর্ণ ও মনোহর এক সত্ত্বার প্রতীক হিসেবে। আর "নবদ্বীপ" হলো চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান, যা বৈষ্ণব ধর্মে অত্যন্ত পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। তবে, অনেক বিশ্লেষক মনে করেন “নবদ্বীপ চন্দ” শুধু কৃষ্ণ নয়, বরং চৈতন্যদেবের প্রতীকী রূপও বটে। কারণ চৈতন্যদেবকে বৈষ্ণবগণ কৃষ্ণেরই অবতার বলে মানেন।

কবি কেন উহাকে নবদ্বীপ চন্দ বলেছেন? গূঢ়ার্থ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা হলো।

এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে পদটির অন্তর্নিহিত ভাবার্থে।

• "নবদ্বীপ চন্দ" বলার মধ্য দিয়ে কবি একদিকে কৃষ্ণের রূপমাধুর্য এবং অপরদিকে চৈতন্যদেবের আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্যকে একত্রে তুলে ধরেছেন।
• “চন্দ” শব্দের মধ্য দিয়ে কবি কৃষ্ণের চাঁদের মতো উজ্জ্বল রূপ ও কোমলতাকে প্রকাশ করেছেন।
• আবার “নবদ্বীপ” শব্দটি চৈতন্যদেবের জন্মভূমিকে নির্দেশ করে, যেখানে প্রেমভক্তির নবজাগরণ ঘটেছিল।

এই পদে কবি রাধার দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুভব করেছেন নবদ্বীপ চন্দ্রের (কৃষ্ণের) সৌন্দর্য, যাঁকে তিনি হৃদয়ে বহন করেন এবং দর্শন করে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। তাই, ‘নবদ্বীপ চন্দ’ নামটি শুধুমাত্র কবি-মননের কাব্যিক কল্পনা নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক অনুভূতির প্রতিফলন।

“নবদ্বীপ চন্দ” বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে কৃষ্ণকে। বৈষ্ণব পদাবলীতে কৃষ্ণকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়—যেমন শ্যাম, মাধব, কানু, চন্দ ইত্যাদি। এখানে "চন্দ" শব্দটি এসেছে "চন্দ্র" অর্থাৎ চাঁদের মত উজ্জ্বল, মাধুর্যপূর্ণ ও মনোহর এক সত্ত্বার প্রতীক হিসেবে। আর "নবদ্বীপ" হলো চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান, যা বৈষ্ণব ধর্মে অত্যন্ত পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। তবে, অনেক বিশ্লেষক মনে করেন “নবদ্বীপ চন্দ” শুধু কৃষ্ণ নয়, বরং চৈতন্যদেবের প্রতীকী রূপও বটে। কারণ চৈতন্যদেবকে বৈষ্ণবগণ কৃষ্ণেরই অবতার বলে মানেন।

উপসংহার:

“আজু হাম কি পেখলু নবদ্বীপ চন্দ”—এই পংক্তিটি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব কবিতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। ব্রজবুলি ভাষায় রচিত এই পদ কেবলমাত্র সাহিত্যিক সৌন্দর্য নয়, বরং এর মধ্যে নিহিত রয়েছে গভীর ভক্তি, প্রেম এবং আধ্যাত্মিক অনুভব। বসন্ত রায়ের কবিত্বময়তায়, রাধার কণ্ঠে ফুটে উঠেছে কৃষ্ণদর্শনের পরম আনন্দ। “নবদ্বীপ চন্দ” রূপে কৃষ্ণ বা চৈতন্যদেবের যে প্রতীকী উপস্থিতি কবি এঁকেছেন, তা আজও পাঠক হৃদয়কে আন্দোলিত করে।

*****2) প্রশ্ন. গৌরচন্দ্রিকা কাকে বলে? সব গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ গৌরচন্দ্রিকা নয় কেন? ৫

ভূমিকা: বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এই সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো গৌরচন্দ্রিকা। গৌরচন্দ্রিকা মূলত একটি কাব্যিক রচনার অংশ, যা প্রধানত শ্রীচৈতন্যদেব বা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর প্রতি ভক্তিভাব প্রকাশের জন্য রচিত। কিন্তু একটি সাধারণ ভুল ধারণা হলো—যে কোনো গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদই গৌরচন্দ্রিকা। এই ধারণাটি ভুল। গৌরচন্দ্রিকা শব্দটির একটি নির্দিষ্ট সাহিত্যিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য রয়েছে। তাই, এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব গৌরচন্দ্রিকা কী, এবং কেন সমস্ত গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ গৌরচন্দ্রিকা নয়।

গৌরচন্দ্রিকা কাকে বলে?

‘গৌরচন্দ্রিকা’ শব্দটি দুটি অংশে বিভক্ত—‘গৌর’ ও ‘চন্দ্রিকা’। ‘গৌর’ বলতে বোঝানো হয়েছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে, যিনি তাঁর গৌরবর্ণ রূপের জন্য এই নাম প্রাপ্ত। ‘চন্দ্রিকা’ মানে হল জ্যোৎস্না বা আলোকচ্ছটা। একসঙ্গে গৌরচন্দ্রিকা শব্দটির অর্থ দাঁড়ায়—‘গৌরাঙ্গপ্রভুর আলোকচ্ছটা’, অর্থাৎ গৌরাঙ্গের প্রশস্তি বা মহিমা বর্ণনা।

সাহিত্যে গৌরচন্দ্রিকা হলো বৈষ্ণব পদাবলীর একটি ভূমিকা স্বরূপ অংশ। এটি সাধারাণত একটি দীর্ঘ কাব্য বা নাটকের শুরুতে রচিত হয়। এর কাজ হলো পাঠক বা শ্রোতার মনে ভক্তিভাব জাগানো, যাতে তারা মূল রচনার (যেমন রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক কাব্য) মধ্যে এক আত্মিক আবেশ নিয়ে প্রবেশ করতে পারেন।

মূল বৈশিষ্ট্য:

১. গৌরচন্দ্রিকা একপ্রকার ভূমিকা পদ।
২. এটি মূলত শ্রীচৈতন্যদেবের মহিমা, লীলাচরিত ও তাঁর ভক্তদের কার্যকলাপ নিয়ে রচিত হয়।
৩. এর মাধ্যমে রচয়িতা ভক্তিরস আনার পরিবেশ তৈরি করেন।
৪. এটি মূল কাহিনীর বা মূল রচনার সূচনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

সব গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ গৌরচন্দ্রিকা নয় কেন?

এখানে একটি মৌলিক বিভ্রান্তি রয়েছে। অনেকে মনে করেন, যেকোনো পদ যেখানে গৌরাঙ্গ বা চৈতন্যদেবের কথা বলা হয়েছে, তা-ই গৌরচন্দ্রিকা। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কারণ, প্রতিটি গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ গৌরচন্দ্রিকার নির্দিষ্ট রচনাশৈলী, উদ্দেশ্য ও কাঠামো অনুসরণ করে না।

বিশ্লেষণ অনুযায়ী কারণগুলি হলো—

১. রচনার কাঠামো ও প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা: গৌরচন্দ্রিকা সাধারণত প্রধান কাব্যের সূচনাপর্বে রচিত হয়। এটি ভূমিকা স্বরূপ। কিন্তু অনেক গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ এককভাবে রচিত হয়েছে, যার পেছনে এমন কোনো প্রধান কাব্যিক কাঠামো বা উদ্দেশ্য নেই। তাই, সেগুলি গৌরচন্দ্রিকা হিসেবে বিবেচিত হয় না।

২. উদ্দেশ্যগত পার্থক্য: গৌরচন্দ্রিকার মূল উদ্দেশ্য হলো ভক্তিরস উদ্রেক করে পাঠক বা শ্রোতাকে মূল লীলাকাব্যে প্রবেশ করানো। অন্যদিকে, অনেক গৌরাঙ্গপদ আছে যেগুলির উদ্দেশ্য কেবল গৌরাঙ্গপ্রেমে আত্মস্থ হওয়া, তাঁর গৌরবগাথা ব্যক্ত করা, বা ব্যক্তিগত ভক্তির প্রকাশ। তাই তাদের গৌরচন্দ্রিকা বলা চলে না।

৩. স্বাধীন পদাবলীর চরিত্র: কিছু গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রচনা, যা কোনো বৃহৎ কাব্যিক কাঠামোর অংশ নয়। ফলে তা গৌরচন্দ্রিকার সংজ্ঞার অন্তর্গত হয় না।

৪. ভূমিকা বা প্রস্তাবনা নয়: গৌরচন্দ্রিকা একটি "ভূমিকা পদ"—এটি প্রধানত অন্য কোনো কাব্য বা নাট্যরচনার সূচনা। কিন্তু কিছু গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ কেবল একটি পূর্ণাঙ্গ রচনা বা স্তোত্র, যা নিজেই সম্পূর্ণ। যেমন: “গৌরঅঙ্গ সুন্দর দেখিয়া মনে...” এই ধরনের পদ চৈতন্যদেবের রূপবর্ণনা করে, কিন্তু এটি মূল কোনো কাব্যের ভূমিকা নয়। তাই একে গৌরচন্দ্রিকা বলা চলে না।

উপসংহার:

সব গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ গৌরচন্দ্রিকা নয়—এই সত্যটি বুঝতে হলে আমাদের গৌরচন্দ্রিকার প্রকৃতি, কাঠামো ও উদ্দেশ্য ভালোভাবে বুঝতে হবে। গৌরচন্দ্রিকা কেবল গৌরাঙ্গের প্রশংসামূলক পদ নয়, এটি একটি নির্দিষ্ট সাহিত্যিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত, যা প্রধানত বৈষ্ণব লীলাকাব্যের সূচনায় রচিত হয়। তাই শুধুমাত্র চৈতন্যদেবকে নিয়ে রচনা হলেই তাকে গৌরচন্দ্রিকা বলা যাবে না। তার সাহিত্যিক কাঠামো, উদ্দেশ্য এবং প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তা বিচার করতে হবে।

*****3) প্রশ্ন. 'দাঁড়াইয়া নন্দের আগে'-কার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে? তাঁর সঙ্গে নন্দের সম্পর্ক কী? পদটি কোন্ পর্যায়ের অন্তর্গত? এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবির কাব্য কৃতিত্ব বিচার করো।

১. 'দাঁড়াইয়া নন্দের আগে'—কার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে?

‘দাঁড়াইয়া নন্দের আগে’—এই পঙক্তিটি মহাকবি বিদ্যাপতির রচিত এক পদ থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে ‘নন্দ’ বলতে যমরাজ নন্দিকে বোঝানো হয়েছে এবং এই পদের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, কৃষ্ণ তাঁর পরলোকগত ভক্তের আত্মাকে উদ্ধার করতে নন্দের (যমদূতের) আগমনের আগেই উপস্থিত হয়েছেন। এই পদে 'নন্দের আগে' দাঁড়ানোর মানে হলো কৃষ্ণ তার ভক্তকে যমরাজের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এখানে মূল প্রসঙ্গ একজন ভক্তের কৃষ্ণপ্রেমের মাহাত্ম্য এবং কৃষ্ণের অসীম দয়ার কথা তুলে ধরা।

২. তাঁর সঙ্গে নন্দের সম্পর্ক কী?

এই পদের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ‘নন্দ’ যমরাজের একজন দূত। পুরাণমতে, নন্দ এবং সুনন্দ যমরাজের অন্যতম সহচর, যারা মৃত্যুর পর পাপীদের আত্মা ধরে নিয়ে যায় যমালয়ে বিচারের জন্য। কিন্তু কৃষ্ণ হলেন ঈশ্বর, তিনি তাঁর ভক্তদের এমনভাবে ভালবাসেন যে প্রয়োজনে মৃত্যুর পরও তাদের উদ্ধার করতে পারেন। এই পদের মধ্যে দিয়ে কবি এক ধরনের অতীন্দ্রিয় ভক্তি প্রকাশ করেছেন, যেখানে কৃষ্ণ নন্দের আগেই এসে তাঁর ভক্তের আত্মা উদ্ধার করেন।

৩. পদটি কোন পর্যায়ের অন্তর্গত?

এই পদটি বৈষ্ণব পদাবলীর অন্তর্গত এবং তা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় ‘পরকীয়া রস-সম্পন্ন’ পর্যায়ের অন্তর্গত। বৈষ্ণব পদাবলীর মূল উপজীব্য বিষয় হলো কৃষ্ণ এবং রাধার প্রেমলীলা এবং ভক্তিরস। যদিও এই পদের মধ্যে পরকীয়া প্রেমের ছাপ নেই, এটি ‘ভক্তিমূলক’ বা ‘ভক্তিরস’ সংবলিত একটি পদ, এবং এটিকে বৈষ্ণব সাহিত্যের ‘নির্গুণ ভক্তি’র পরিবর্তে ‘সগুণ ভক্তি’ ধারার প্রতিফলন হিসেবে দেখা যায়।

৪. এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবির কাব্য কৃতিত্ব বিচার করো।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলীর একটি বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, ভনুদাস, ধ্রুবদাস প্রমুখ কবি উল্লেখযোগ্য। তবে তাঁদের মধ্যে বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাস সবচেয়ে বিশিষ্ট।

বিদ্যাপতির কাব্য কৃতিত্ব:

বিদ্যাপতি ছিলেন মৈথিলী ভাষার কবি, তবে তাঁর প্রভাব বাংলাতেও গভীরভাবে পড়ে। বাংলার কবিরা তাঁর ভাষা অনুসরণ করে পদ রচনা করেছেন। বিদ্যাপতির পদগুলিতে শরীরী প্রেম, রাধা-কৃষ্ণের লীলাখেলা, ভক্তি, দুঃখ, বিরহ, আনন্দ—এইসব মানবিক অনুভূতির অপূর্ব প্রকাশ ঘটেছে।

তাঁর কাব্যে পরিণত প্রেম এবং পার্থিব প্রেমের অপূর্ব মেলবন্ধন দেখা যায়। বিদ্যাপতির বৈষ্ণব পদাবলী বাংলা ভাষার প্রাচীন ভক্তিসাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তাঁর কাব্যে একাধারে রয়েছে হৃদয়স্পর্শী ভাষা, সংগীতের ছন্দ, এবং গভীর ভাববোধ। সেই জন্য তাঁকে বৈষ্ণব সাহিত্যের অন্যতম পথপ্রদর্শক বলা হয়।

চণ্ডীদাসের কাব্য কৃতিত্ব:

চণ্ডীদাস বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি ‘সত্য প্রেমই ধর্ম’—এই মর্মবাণীকে তাঁর সাহিত্যের মুখ্য উপজীব্য করেছেন। তাঁর রচনায় প্রেম এবং ভক্তির এক অনন্য সম্মিলন ঘটেছে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে অবলম্বন করে চণ্ডীদাস মানবজীবনের গভীর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। তাঁর পদগুলিতে গভীর মনন, কবিত্ব এবং সরল আবেগের অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়।

এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ:

এই পর্যায়ের কবিদের কাব্য সাধারণত সংক্ষিপ্ত, ছন্দোবদ্ধ, সংগীতোপযোগী এবং আবেগপ্রবণ। কাব্যের ভাষা সাধারণ মানুষদের কাছে সহজবোধ্য হলেও তার ভাব গভীর। এই কাব্যধারার মূল উদ্দেশ্য ছিল ঈশ্বরের প্রতি অকৃত্রিম প্রেম, ভক্তি এবং মানব-মানবীর মধ্যকার সম্পর্কের মাধ্যমে ঐশ্বরিক প্রেমকে বোঝানো।

উপসংহার:

দাঁড়াইয়া নন্দের আগে’ পংক্তিটি বৈষ্ণব সাহিত্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যেখানে কৃষ্ণভক্তি এবং ভক্তির চূড়ান্ত পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। এই ধারা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন রসধারার সৃষ্টি করেছে, যেখানে প্রেম, দুঃখ, বিরহ ও ঈশ্বরপ্রেম একাকার হয়ে গিয়েছে। বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের মতো কবিরা এই সাহিত্যকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির গর্ব।

খ. কৃত্তিবাসী রামায়ণ

*****4) প্রশ্ন. 'রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে সীতা চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর। (১০/৫)

উত্তর: রামায়ণ, মহর্ষি বাল্মীকির অমর কাব্যগ্রন্থ, ভারতীয় সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন। রামায়ণ প্রধানত সাতটি কাণ্ডে বিভক্ত— বালকাণ্ড, অয়োধ্যাকাণ্ড, অরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, সুন্দরকাণ্ড, লঙ্কাকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড। এই মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় নারীচরিত্র হলেন সীতা। বিশেষত উত্তরকাণ্ডে সীতার চরিত্র চূড়ান্ত গভীরতা ও বেদনার ছোঁয়ায় অলংকৃত হয়েছে। এই কাণ্ডে আমরা সীতাকে একজন স্ত্রী, মা, রাজারাণী এবং একজন আত্মসম্মান-বান মহিলার ভূমিকায় দেখতে পাই।

উত্তরকাণ্ডে সীতার চরিত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিচে আলোচিত হলো:

১. আত্মসম্মানবোধ ও আত্মগরিমা: উত্তরকাণ্ডে সীতার আত্মসম্মানবোধ তার চরিত্রের অন্যতম প্রধান দিক। যখন রাম জনগণের সন্দেহ দূর করতে তাকে পরিত্যাগ করেন, তখন সীতা তা মেনে নেন। কিন্তু তার এই গ্রহণে কোনো লঘুতা ছিল না; বরং এতে তার আত্মমর্যাদা ফুটে ওঠে। তিনি রাজার আদেশ মেনে বনবাস গ্রহণ করেন, কিন্তু মনে মনে জানেন যে তিনি নির্দোষ। সমাজের চোখে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য বারবার পরীক্ষা দেওয়ার চেয়ে তিনি নিজের নীরব গাম্ভীর্যকে শ্রেয় মনে করেন।

২. ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা: সীতা চরিত্রের অন্যতম মহৎ গুণ হলো ধৈর্য। বনবাসে লব ও কুশকে জন্ম দিয়ে তাদের বড়ো করে তোলা, সন্ন্যাসী বাল্মীকির আশ্রমে সকল কষ্ট সহ্য করা— এগুলো এক অনন্য ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার প্রমাণ। জীবনের প্রতিটি কঠিন মুহূর্তে তিনি শান্ত ও সংযত থেকেছেন, যা একজন আদর্শ নারীর প্রতিচ্ছবি।

৩. মাতৃত্বের মাধুর্য: সীতা একজন আদর্শ মা। লব ও কুশের জন্ম ও শিক্ষা-দীক্ষা তিনি নিজ হাতে পরিচালনা করেছেন। বাল্মীকির আশ্রমে দুই পুত্রকে ধর্ম, নীতি ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলেন। তিনি শুধু জন্মদাত্রী নন, একজন শিক্ষয়িত্রীও। মাতৃত্বের এই নিঃস্বার্থ রূপ উত্তরকাণ্ডে অত্যন্ত মনোগ্রাহীভাবে চিত্রিত হয়েছে।

৪. স্ত্রী হিসেবে কর্তব্যপরায়ণতা: সীতা শুধুমাত্র একজন প্রেমময়ী স্ত্রী নন, তিনি কর্তব্যপরায়ণ রাজারাণীও বটে। প্রজাদের কল্যাণ ও স্বামী রামের মর্যাদার জন্য তিনি নিজের জীবনের সুখ বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেননি। যখন রাম জনসাধারণের চাপের মুখে তাঁকে ত্যাগ করেন, তখন তিনি কোনো অভিযোগ না করেই বনবাসে চলে যান। এটি তাঁর চরিত্রের কর্তব্যপরায়ণ ও আত্মনিবেদিত রূপকে তুলে ধরে।

৫. নৈতিক দৃঢ়তা ও সতীত্বের প্রতীক: সীতা চরিত্র রামায়ণে সতীত্বের এক প্রতীক। তিনি রাবণের লাঞ্ছনার পর অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে পবিত্র প্রমাণ করেন। উত্তরকাণ্ডে আবারও যখন প্রশ্ন উঠে, তিনি পৃথিবী মাতার কাছে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করে চিরবিদায় নেন। এই আত্মবলিদান সীতার চরিত্রে এক অতুলনীয় নৈতিক দৃঢ়তা ও মহিমা যোগ করেছে।

৬. নির্মলতা ও সংযম: সীতা চরিত্রে এক নির্মল, শান্ত, সংযত নারীর প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। তিনি কখনো উচ্চবাচ্য করেননি, রামের প্রতি বিরূপতা দেখাননি, এমনকি সমাজকেও দোষারোপ করেননি। তার অন্তর যন্ত্রণাময় হলেও তিনি সবকিছু মনের মধ্যে ধারণ করে রাখেন, যা তার মানসিক দৃঢ়তাকেই নির্দেশ করে।

৭. আত্মত্যাগের আদর্শ: উত্তরকাণ্ডের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্য হলো সীতার ধরাধামে বিলীন হওয়া। যখন পুনরায় রাজসভায় তার সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তিনি বলেন— "যদি আমি সতী হয়ে থাকি, তবে হে ধরিত্রী, তুমি আমাকে গ্রহণ করো।" তখন ভূমিদেবী তার কোলের মধ্যে স্থান দেন। এ ঘটনা তার আত্মসম্মানবোধ, আত্মত্যাগ ও আত্মশক্তির এক নিদর্শন হয়ে আছে।

৮. নারীত্বের শক্তি ও প্রতিবাদ: সীতা একদিকে মমতাময়ী, সহনশীল স্ত্রী, মা ও রাজারাণী, অপরদিকে তিনি প্রতিবাদীও। যদিও তিনি কণ্ঠে উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করেন না, কিন্তু তার কাজের মধ্য দিয়ে, বিশেষত ধরাধামে লীন হয়ে, তিনি সমাজের ভুল দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে এক মৌন কিন্তু প্রবল প্রতিবাদ জানান।

৯. আধ্যাত্মিক মহিমা: উত্তরকাণ্ডে সীতার চরিত্র শুধুমাত্র একটি মানবীয় নারী চরিত্রে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাকে এক দেবীস্বরূপ রূপে তুলে ধরা হয়েছে। ভূমিদেবীর কন্যা হিসেবে তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারিণী রূপে চিত্রিত।

১০. আদর্শ নারীচরিত্র: রামায়ণের সীতা শুধু প্রাচীন কালের এক কাহিনির অংশ নন, বরং তিনি এক আদর্শ নারীর প্রতীক, যিনি আজও ভারতীয় সমাজে পবিত্রতা, সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, মমতা ও আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি হিসেবে পূজিতা হন।

উপসংহার: রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে সীতা চরিত্র একদিকে বেদনার, অন্যদিকে মহিমার। সমাজের অন্যায়, ভুল দৃষ্টিভঙ্গি এবং পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের মুখোমুখি হয়েও তিনি কখনো আত্মসম্মান বিসর্জন দেননি। তার সতীত্ব, সহনশীলতা, ধৈর্য এবং আত্মত্যাগ তাঁকে দেবীতুল্য মর্যাদায় পৌঁছে দেয়। সীতার চরিত্র নারীশক্তির এক দীপ্ত প্রতীক — যিনি মৌনতাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন, আর আত্মত্যাগকে পরিণত করেছেন মহৎ আদর্শে।

*****5) প্রশ্ন.রাবণ চরিত্র পরিকল্পনায় কৃত্তিবাসের স্বকীয়তার পরিচয় দাও। (৫/১০)

ভূমিকা: কৃত্তিবাস ওঝা বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের একজন বিশিষ্ট কবি। তাঁর লেখা ‘শ্রীরামচরিত’ বা ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ বাঙালি সমাজে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ধর্মগ্রন্থ। বাল্মীকি রচিত মূল ‘রামায়ণ’ অবলম্বনে রচিত হলেও কৃত্তিবাস তাঁর নিজস্ব কাব্যদৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মবোধ, সমাজচিন্তা এবং কাব্যরুচির ভিত্তিতে চরিত্রগুলোকে রূপায়িত করেছেন। এই রচনায় রাবণ চরিত্রটি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যায়, কৃত্তিবাস শুধুমাত্র অনুকরণ করেননি, বরং তাঁর নিজস্ব ভাবনার ছাপ রেখেছেন। কৃত্তিবাসের রাবণ একদিকে যেমন পৌরাণিক খলনায়ক, অন্যদিকে তিনি একটি জটিল মানবিক চরিত্রও—যার মধ্যে রয়েছে গর্ব, শক্তি, বীরত্ব, বিদ্বেষ, অনুশোচনা, ভক্তি এবং নিষ্ঠা।

রাবণের বংশ পরিচয় ও গৌরবময় অতীত: কৃত্তিবাস রাবণের মহত্ত্ব ও বংশগৌরব সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি রাবণকে শুধু এক স্বর্গীয় দৈত্য বা রাক্ষসরূপে উপস্থাপন করেননি, বরং তাকে ঋষিপুত্র, স্বর্ণলঙ্কার রাজা এবং এক মহাশক্তিশালী রাজা হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর দশমাথা ও বিশাল শরীর, পাণ্ডিত্য এবং প্রতাপ বর্ণনায় কৃত্তিবাস যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। এইভাবে কৃত্তিবাস রাবণের সামাজিক অবস্থান ও ক্ষমতার গুরুত্ব পাঠকের কাছে তুলে ধরেন। তিনি রাবণকে শুধু নিন্দনীয় রূপে নয়, বরং শ্রদ্ধার সঙ্গেও উপস্থাপন করেন।

রাবণ চরিত্রে মানবিকতার ছাপ: কৃত্তিবাস রাবণের চরিত্রে মানবিকতা যুক্ত করেছেন, যা বাল্মীকি কাব্যে তুলনামূলকভাবে অনুপস্থিত। লঙ্কারাজ রাবণ যতই অহংকারী বা পাপিষ্ঠ হোন না কেন, কৃত্তিবাস তাঁকে একটি আবেগপ্রবণ মানুষ হিসেবে চিত্রিত করেন। সীতাহরণ পর্বে তাঁর মধ্যে প্রেম, আকর্ষণ এবং কামনার প্রকাশ যেমন আছে, তেমনই পরবর্তীতে রামের ভয়ে নয়, বরং এক যোদ্ধার গর্বে তিনি যুদ্ধ করেন।

রাবণ যখন সীতাকে অপহরণ করেন, কৃত্তিবাস দেখান যে, তিনি কোনও হীনমন্য উদ্দেশ্যে সীতাকে হরণ করেননি; বরং এটি ছিল তাঁর মর্যাদার লড়াই, যা এসেছে শূর্পণখার অপমান থেকে। এখানে রাবণ এক দয়ালু ভাই, যিনি বোনের সম্মান রক্ষার্থে যুদ্ধের ঝুঁকি নেন।

রাবণের পাণ্ডিত্য ও বুদ্ধিমত্তা: কৃত্তিবাস রাবণের পাণ্ডিত্য ও বুদ্ধিমত্তার দিকটি খুব জোর দিয়ে দেখিয়েছেন। রাবণ একাধারে বেদজ্ঞ, সংগীতজ্ঞ, তন্ত্রসাধক, আয়ুর্বেদ বিশারদ ও যুদ্ধবিশারদ। তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায় যখন তিনি শিবের উপাসনায় লিপ্ত হন বা যখন সে বিভিন্ন তর্কে অংশগ্রহণ করে। এমনকি মৃত্যুর আগে রাবণ লক্ষ্মণকে জ্ঞানদান করেন—এই অংশটি কৃত্তিবাস তাঁর মূল ভাবনাপ্রসূত সংযোজন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কৃত্তিবাস রাবণকে এক ‘জ্ঞানী দুষ্ট চরিত্র’ হিসেবে গড়ে তোলেন—যিনি ন্যায় ও অনর্থের দ্বন্দ্বে পতিত।

পিতা ও রাজার ভূমিকা: কৃত্তিবাসের রাবণ তাঁর পুত্র ইন্দ্রজিৎ-এর মৃত্যুতে শোকাহত হন। এই আবেগঘন দৃশ্য রাবণ চরিত্রে এক করুণ মানবিক স্পর্শ এনে দেয়। তিনি একজন স্নেহশীল পিতা, যিনি সন্তানের মৃত্যুতে কাঁদেন এবং প্রতিশোধের অঙ্গীকার করেন। এই মুহূর্তে পাঠক রাবণের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। এছাড়াও কৃত্তিবাস দেখিয়েছেন যে রাবণ নিজের প্রজাদের ভালোবাসেন। যুদ্ধের আগে তিনি প্রজাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁদের অন্যত্র সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এই দায়িত্বশীল রাজার রূপ বাল্মীকি কাব্যে এতটা প্রকট নয়।

শৃঙ্গার রস ও রাবণ: কৃত্তিবাস তাঁর কাব্যে রাবণের প্রেমবোধ, কামনা এবং আকর্ষণের প্রকাশে যে শৃঙ্গার রসের অবতারণা করেছেন, তা সাহিত্যে রাবণকে একটি জীবন্ত ও মানবিক চরিত্র করে তোলে। তিনি সীতার প্রতি কামের কারণে নয়, সৌন্দর্যবোধ ও সম্মানের কারণে আকৃষ্ট হন। যদিও এই আকর্ষণ পরিণামে ভুল পথে তাঁকে চালিত করে, তবুও এটি একপেশে খলচরিত্র নয়।

চরিত্রের দ্বৈততা ও ট্র্যাজিক হিরো রূপ: কৃত্তিবাস রাবণকে এমনভাবে গড়েছেন যে, পাঠকের মনে তার জন্য একধরনের সহানুভূতি জাগে। তিনি একাধারে বীর, পণ্ডিত, রাজা, পিতা, ভক্ত, আবার অপরাধীও। এই বৈপরীত্যই কৃত্তিবাসের স্বকীয়তা। তাঁর রাবণ কেবল ধ্বংসযোগ্য দানব নয়; বরং এক ট্র্যাজিক হিরো, যিনি নিজের অহংকার ও প্রবৃত্তির কারণে পতিত হন।

ভাষা ও বর্ণনার স্বাতন্ত্র্য: কৃত্তিবাসের ভাষা সহজ, প্রাঞ্জল এবং আবেগপূর্ণ। তিনি রাবণের প্রতি ঘৃণা দেখান না, বরং একটি সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চরিত্রটি উপস্থাপন করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি বাঙালি পাঠকের মনে রাবণকে একটি বহুমাত্রিক চরিত্র হিসেবে গড়ে তোলে। তাঁর তুলনামূলক কাব্যিক এবং নাটকীয় ভাষা রাবণকে জীবন্ত করে তোলে।

রাবণের অহংকার ও পতনের কারণ: রাবণের মূল পতনের কারণ হিসেবে কৃত্তিবাস অহংকারকে দেখিয়েছেন। সীতা হরণ, রামের প্রতি বিদ্বেষ এবং নিজের অপরাজেয়তা সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস—সবকিছুই তার অহংকারেরই প্রকাশ। কৃত্তিবাস এখানে একটি নৈতিক বার্তা তুলে ধরেন—অহংকার যেকোনো জ্ঞানী বা প্রতাপশালী ব্যক্তির পতনের মূল কারণ হতে পারে। তিনি রাবণের পতনকে ঈশ্বরের বিধান হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং বলেন যে, "অহংকারে মহাপাত, সেতু বাধে সাধু কথা।"

রাবণের ভ্রাতৃস্নেহ ও পারিবারিক সম্পর্ক: কৃত্তিবাস রাবণের পারিবারিক সম্পর্কের দিকেও আলোকপাত করেছেন। কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ এবং ইন্দ্রজিতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, তাঁর বোন শূর্পণখার প্রতি স্নেহ—সবই একটি মানবিক রাবণের চিত্র তুলে ধরে। তিনি রাজা হলেও ভাইয়ের মৃত্যুতে শোকাহত হন, পুত্র ইন্দ্রজিতের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন—এসব কৃত্তিবাসের কাব্যদৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কৃত্তিবাসের কাছে রাবণ কেবল একটি দৈত্য নয়, বরং একজন রক্তমাংসের মানুষ, যিনি অনুভব করতে পারেন, কাঁদতে পারেন এবং ভালোবাসতে পারেন।

উপসংহার:

রাবণ চরিত্রের উপস্থাপনায় কৃত্তিবাস যে স্বকীয়তা দেখিয়েছেন, তা বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি রাবণকে কেবল একপাক্ষিক খলনায়ক হিসেবে দেখাননি, বরং এক জটিল, বহুমাত্রিক, মানবিক চরিত্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তাঁর এই চরিত্রচিত্রণে ধর্মীয় ভাব, নৈতিক শিক্ষা এবং মানবতাবোধের সমন্বয় ঘটেছে। কৃত্তিবাসের এই অনন্য কৌশলই তাঁর কাব্যের চিরকালীন জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। কৃত্তিবাসের রাবণ আমাদের শেখায়—শক্তি ও গর্ব থাকলেও আত্মসমালোচনা ও বিনয়ই একজন ব্যক্তির প্রকৃত মহত্বের পরিচয়।

গ. অন্নদামঙ্গল

*****6) প্রশ্ন. অন্নদামঙ্গল কাব্যকে “নূতন মঙ্গল” অভিধায় অভিহিত করা হয় কেনো?

উত্তর: বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এই ধারার অন্তর্ভুক্ত কাব্যগুলি সাধারণত দেব-দেবীর মাহাত্ম্য ও তাঁদের অনুগামী ভক্তদের কাহিনি নিয়ে রচিত। এগুলি মূলত ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে গ্রামীণ জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু এই ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম তৈরি করেন ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর কালজয়ী কাব্য “অন্নদামঙ্গল”-এ। এই কাব্যটিকে “নূতন মঙ্গল” বলা হয় কারণ এটি ঐতিহ্যবাহী মঙ্গলকাব্যের কাঠামো বজায় রেখেও কাহিনির গভীরতা, চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, ভাষার পরিমার্জন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এক নতুন যুগের সূচনা করে। নিচে এই অভিহিতির পেছনের কারণগুলি বিশদে আলোচনা করা হলো।

১. মঙ্গলকাব্যের রীতির অনুসরণে নবত্ব আনা: বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্যগুলিতে সাধারণত দেখা যায় – দেবতা বা দেবী স্বপ্নযোগে কোনো রাজাকে নিজের পূজা চালুর নির্দেশ দেন, সেই রাজা প্রথমে অবজ্ঞা করেন এবং পরে বিপদে পড়ে ঈশ্বরের মাহাত্ম্যে বিশ্বাসী হন। এই মূল কাঠামো অন্নদামঙ্গলেও রয়েছে – দেবী অন্নপূর্ণা স্বপ্নে রাজা শিবসিংহকে নির্দেশ দেন এবং তাঁর অরাজক রাজ্য পূর্ণতা পায় দেবীর কৃপায়। কিন্তু ভারতচন্দ্র এই মূল কাঠামোকে আশ্রয় করে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন। ফলে এটি কেবল ধর্মীয় মাহাত্ম্যবর্ণনামূলক নয়, বরং কাব্যিক সৌন্দর্যে ও মানবচরিত্র বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ একটি সাহিত্য রূপ নেয়।

২. মানবচরিত্রের গভীর বিশ্লেষণ: অন্নদামঙ্গল কাব্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ “বিদ্যাসুন্দর পর্ব”। এই অংশে দেবীর মাহাত্ম্য ছাপিয়ে বিদ্যাসুন্দর ও রাজকুমারী লবঙ্গলতার প্রেমকাহিনি এক নতুন মাত্রা লাভ করে। বিদ্যাসুন্দর একাধারে বুদ্ধিমান, কূটনৈতিক ও প্রেমিক চরিত্র। তাঁর প্রেম ও রাজনৈতিক অভিসন্ধি একইসঙ্গে কাব্যটিকে সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতির প্রতিফলন হিসেবে গড়ে তোলে। লবঙ্গলতার চরিত্রেও কাব্যিক কোমলতা ও কৌতূহলপূর্ণ মানসিকতা দেখা যায়। এত গভীরভাবে চরিত্রচিত্রণ প্রাচীন মঙ্গলকাব্যে সচরাচর দেখা যায় না।

৩. ভাষার শৈল্পিকতা ও রুচিশীল কাব্যরীতি: ভারতচন্দ্র মঙ্গলকাব্যের ভাষারীতি থেকে অনেকটাই সরে এসে সাধু ও চিত্ররূপময় কাব্যিক বাংলা ভাষার সূচনা করেন। তাঁর ভাষা উচ্চমানের, গদ্যতুল্য অথচ ছন্দোবদ্ধ ও অলঙ্কারবহুল। চিত্রকল্প, উপমা, রূপক ব্যবহার করে তিনি যে সাহিত্যভাষা নির্মাণ করেন, তা বাংলা কাব্যভাষার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তাঁর ভাষায় সংস্কৃত প্রভাব থাকলেও তা কখনো দুর্বোধ্য হয়ে ওঠেনি। ফলে অন্নদামঙ্গল কাব্য শ্রুতিমধুর ও পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে।

৪. সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতির চিত্র: মঙ্গলকাব্য সাধারণত অলৌকিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে গঠিত। কিন্তু ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্যে রাজনীতি, প্রশাসন, সমাজের অবক্ষয় ও অভিজাত শ্রেণির চালচলনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেন। যেমন – কাহিনির মধ্যে রাজদরবারের রাজনীতি, মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন, প্রেম ও বিবাহনীতি, দূত প্রেরণের কৌশল ইত্যাদি বিষয় এসেছে। এর ফলে কাব্যটি কেবল ধর্মীয় নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপও লাভ করে, যা মঙ্গলকাব্যে বিরল।

৫. প্রেমকাহিনির প্রাধান্য ও নাটকীয়তা : বিদ্যাসুন্দর ও লবঙ্গলতার প্রেমকাহিনিতে নাট্যগুণ ও কাব্যরোমান্স একত্রিত হয়েছে। প্রেম, বাধা, যুদ্ধ, কূটনীতি, অভিসার ও মিলন – সব মিলিয়ে কাহিনি এক নাট্যরস সৃষ্টি করে। এই ধরনের প্রেমোপাখ্যান প্রাচীন মঙ্গলকাব্যে দেখা যায় না। ভারতচন্দ্র প্রেমকে এক উচ্চতর সৌন্দর্যে উন্নীত করেন এবং তাকে ধর্মকেন্দ্রিক কাহিনির মধ্যে সুনিপুণভাবে বুনে দেন।

৬. ধর্মীয় কাহিনির অগ্রাধিকার নয়: অন্নদামঙ্গলে দেবী অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্য থাকলেও তা কাহিনির মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠেনি। দেবীর মাহাত্ম্য যেমন রয়েছে, তেমনি মানবিক চরিত্রের উত্থান-পতন, মানব-সমাজের জটিলতা এবং রাজনীতির নানান দিক এই কাব্যকে বহুমাত্রিক করে তোলে। ফলে এটি ধর্মপ্রচারের বাহন না হয়ে এক পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যসৃষ্টিতে পরিণত হয়।

৭. নতুন যুগের সূচনা: অন্নদামঙ্গল কাব্য বাংলা কাব্যধারার এক যুগান্তকারী রচনা। এটি বাংলা সাহিত্যে নতুন রুচির সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালে এই কাব্য রামমোহন রায় থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনেক মনীষী দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হয়। এ কাব্য কেবল মঙ্গলকাব্যের ধারাবাহিকতাই নয়, বরং বাংলা সাহিত্যের নবযুগের ভিত্তিপ্রস্তর।

উপসংহার:

সবদিক বিচার করলে বলা যায়, ভারতচন্দ্রের “অন্নদামঙ্গল” কাব্য মঙ্গলকাব্যের কাঠামো অনুসরণ করেও সাহিত্যের ভিন্নধর্মী এক নিদর্শন হয়ে উঠেছে। এটি কেবল দেবী মাহাত্ম্যের কাহিনি নয়, বরং এক প্রেমোপাখ্যান, রাজনীতি ও সমাজচিত্রের সম্মিলিত প্রকাশ। ভাষার উৎকর্ষ, চরিত্রের বর্ণনা ও কাহিনির নাটকীয়তা – সব মিলিয়ে এটি এক নবযুগের কাব্য। সেই কারণে এই কাব্যকে যথার্থই “নূতন মঙ্গল” অভিধায় অভিহিত করা হয়।

ঘ. শাক্ত পদাবলী (নির্বাচিত পদ)

*****6) প্রশ্ন. “গিরি, এবার আমার উমা এলে” — শাক্ত পদাবলিতে রামপ্রসাদ সেনের কাব্যভাবনা ও কাব্যভাষা আলোচনা করো।

ভূমিকা: বাংলা সাহিত্যের ভক্তিমূলক ধারায় শাক্ত পদাবলি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এই ধারায় সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী কবি হলেন রামপ্রসাদ সেন (১৭১৮-১৭৭৫)। তিনি দেবী কালিকার প্রতি অসীম ভক্তি, গভীর আত্মিক অনুরাগ ও পারিবারিক আবহে দেবীকে উপস্থাপন করে বাংলা কাব্যভাণ্ডারে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন। তাঁর বিখ্যাত পদ “গিরি, এবার আমার উমা এলে” শুধু কাব্যিক সৌন্দর্যে নয়, শাক্ত ভাবধারার অভিনব রূপায়ণেও অনন্য।

রামপ্রসাদ সেনের কাব্যভাবনা: রামপ্রসাদ সেনের শাক্ত কাব্যে দেবী কালিকা কেবল এক পূজনীয় দেবী নন, তিনি সন্তানের মতো মা, সখীর মতো প্রিয়, আবার কখনো কন্যা উমা। তাঁর কাব্যে ধর্মীয় গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিগত অনুভবের এক অপূর্ব মিশেল দেখা যায়। এই পদের পটভূমিতে মহাদেব (গিরিশ) এবং পার্বতীর (উমা) পিতৃগৃহ থেকে পতিগৃহে আগমনের মিথ ব্যবহার করে রামপ্রসাদ মানবীয় সম্পর্কের আবেগকে ধর্মীয় উপাসনার রূপে রূপান্তরিত করেছেন।

“গিরি, এবার আমার উমা এলে”—এই পদের মাধ্যমে তিনি যেন দেবী উমাকে তাঁর নিজের মেয়ে রূপে কল্পনা করছেন, যিনি কষ্ট পেয়ে সংসারে ফিরে এসেছেন। এই ভাবনার মধ্য দিয়ে ভক্তি-ভাষ্যে এক মানবিক, করুণ এবং গভীর আবেগঘন ধারা সৃষ্টি হয়েছে।

শাক্ত ভাবধারার প্রতিফলন: রামপ্রসাদের কাব্যে শাক্ত তত্ত্ব শুধু দার্শনিক ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা একেবারে দৈনন্দিন জীবনের ভাষায় প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি দেবীকে যেমন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শক্তিরূপে কল্পনা করেছেন, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনের মা, কন্যা, স্ত্রী, সখী হিসেবেও দেখেছেন। উক্ত পদে দেবী উমা স্বামীঘরে গিয়ে নির্যাতিত হয়েছেন, তাই পিতার কাছে ফিরে আসেন — এই কল্পনার মধ্যে এক মানবিক যন্ত্রণা, করুণা এবং করুণাবোধ প্রকাশ পেয়েছে।

এই পদের মাধ্যমে রামপ্রসাদ যেন এক শাক্ত দর্শনের অন্তর্নিহিত প্রেম ও দুঃখবোধকে সহজ-সরল অথচ গভীর ভাষায় ব্যক্ত করেছেন।

কাব্যিক ভাষা ও রচনাশৈলী: রামপ্রসাদ সেনের কাব্যভাষা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি। তিনি সংস্কৃতঘেঁষা দার্শনিক ভাষার পরিবর্তে লোকজ ভাষা ব্যবহার করে ভক্তিবাদী কাব্যকে মানুষের নিকটবর্তী করে তুলেছেন। “গিরি, এবার আমার উমা এলে” পদে তিনি পার্বতীকে নিজের মেয়ের মতো কল্পনা করে বলেছেন—

“গিরি, এবার আমার উমা এলে
কত যে কষ্ট তার পিত্রালয়ে বললে।”

এই ধরনের বাক্য বিন্যাসে সাধারণ মা ও মেয়ের সম্পর্কের আবেগ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ভক্ত ও দেবীর মধ্যকার অন্তরঙ্গতা। এখানে ভাষার সরলতা ভক্তির গভীরতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।

এই ধরনের বাক্য বিন্যাসে সাধারণ মা ও মেয়ের সম্পর্কের আবেগ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ভক্ত ও দেবীর মধ্যকার অন্তরঙ্গতা। এখানে ভাষার সরলতা ভক্তির গভীরতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।

রামপ্রসাদের আর একটি কৌশল হল লোকসাহিত্য থেকে উপমা গ্রহণ। তিনি ঘরোয়া উপমা, দৈনন্দিন জীবনের চিত্র, সাধারণ সংসারী মানুষের অনুভব ব্যবহার করে দেবীকে আরও মানবিক করে তুলেছেন। তাঁর পদের অন্তর্গত ছন্দও সহজ ও সুরেলা—যা গান রূপে পরিবেশনের উপযোগী।

মানবিক ও দার্শনিক ভাবের মেলবন্ধন: এই পদের আর একটি দিক হল মানবিক আবেগের সঙ্গে আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তির সমন্বয়। দেবীকে যেমন সংসারে নির্যাতিতা কন্যারূপে দেখা হয়েছে, তেমনই তাঁর আগমনে সৃষ্টির মধ্যে শান্তি, প্রেম ও রমণীয়তার বার্তাও আছে। এই কল্পনার মধ্য দিয়ে রামপ্রসাদ একদিকে সংসারজীবনের কঠিন বাস্তবকে তুলে ধরেন, অন্যদিকে ঈশ্বরতত্ত্বকেও সহজবোধ্য করে তোলেন।

ভক্তি ও আনুগত্যের প্রকাশ:

রামপ্রসাদের পদে ভক্তি কেবল নিয়মিত পূজা-আর্চনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা এক নির্ভেজাল আত্মসমর্পণের রূপ নেয়। “উমা” বা “কালী” তাঁর কাছে কখনো মা, কখনো বন্ধু, আবার কখনো প্রেমিকা। এই বহুমাত্রিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তিনি একজন সাধারণ ভক্তের হৃদয়ের গভীর আকাঙ্ক্ষা ও বেদনার ভাষা তুলে ধরেছেন।

এই পদের প্রতিটি পঙক্তিতে আমরা অনুভব করতে পারি সেই করুণ আর্তি, যেখানে তিনি যেন বলতে চান— এই মা আর সেই মা নেই; তিনি সংসারে গিয়ে কষ্ট পেয়েছেন, এখন ফিরেছেন, তাঁকে আগলে রাখতে হবে।

উপসংহার:

রামপ্রসাদ সেন বাংলা সাহিত্যে শাক্ত ভক্তির এক মহান পথিকৃৎ। তাঁর কাব্যে দেবী কালী বা উমা কোনও দূরবর্তী অলৌকিক সত্তা নন, বরং একজন মা, কন্যা, প্রিয়জন। “গিরি, এবার আমার উমা এলে” পদে তিনি যে কাব্যভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তা শাক্ত তত্ত্বকে মানুষের হৃদয়ের খুব কাছে নিয়ে এসেছে। কাব্যভাষার সরলতা, আবেগঘনতা, এবং লোকজ উপাদানের মিশেলে তিনি এক নতুন কাব্যরীতি সৃষ্টি করেন, যা আজও সমানভাবে সমাদৃত।

Kalyani University B.A 4th Semester Bengali Major 401 NEP ছোট প্রশ্ন, বড়ো প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন PDF টি পেতে.. আপনি 150 টাকা পেমেন্ট করুন। পেমেন্টের পর এক সেকেন্ডের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাজেশনটি পাবেন। ধন্যবাদ। টাকা টি পেমেন্ট করার জন্য নিচে PAY বাটনে ক্লিক করুন।

অথবা আপনি চাইলে সরাসরি PhonePe-এর মাধ্যমে 150 টাকা পেমেন্ট করে সাজেশন সংগ্রহ করতে পারেন। PhonePe নম্বর: 6295668424 (পেমেন্টের পর স্ক্রিনশট হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালে PDF COPY পাঠিয়ে দেব।)

My Phone Number- 6295668424

Bengali Major 2nd Paper 402 Nep Suggestion