Kalyani University B.A 4th Semester Bengali Major 402 suggestions

Kalyani University Suggestion

Kalyani University B.A 4th Semester Bengali Major 402 Suggestions 2025

কাব্যের রূপভেদ ও আধুনিক বাংলা কাব্য-কবিতা

Kalyani University B.A 4th Semester Bengali Major 402 NEP ছোট প্রশ্ন, বড়ো প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন PDF টি পেতে.. আপনি 150 টাকা পেমেন্ট করুন। পেমেন্টের পর এক সেকেন্ডের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাজেশনটি পাবেন। ধন্যবাদ। টাকা টি পেমেন্ট করার জন্য নিচে PAY বাটনে ক্লিক করুন।

My Phone Number- 6295668424

• এই সাজেশনের বড়ো প্রশ্ন সংখ্যা 30 টি।
ছোট প্রশ্ন প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন পাবেন।
• নিরক্ষরেখে বলতে পারি এই সাজেশনেরর বাইরে কোন প্রশ্ন উত্তর আসবে না।
• ১০০% তোমরা কমন পাবে।
• এই সাজেশনের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সিলেবাস অনুযায়ী এবং ইউনিট অনুযায়ী সাজানো রয়েছে ।
• তোমরা চাইলে খুব সহজে BUY করতে পারো।
• THANK YOU.

এখানে অল্প কিছু প্রশ্নোত্তর আপলোড করা হয়েছে যদি তোমার মনে হয় সাজেশনটি BUY করতে পারো ।

(সিলেবাস – ২০২৫)

কাব্যের রূপভেদ ও আধুনিক বাংলা কাব্য-কবিতা

(ক) কাব্যের রূপভেদ:
মহাকাব্য, গীতিকাব্য, সনেট, আখ্যানকাব্য, পত্রকাব্য, শোককাব্য, স্তোত্রকবিতা।

(খ) বীরাঙ্গনা কাব্য (মধুসূদন দত্ত):
পাঠ্য পত্রিকা –
দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা
সোমের প্রতি তারা
দশরথের প্রতি কেকেই
নীলধ্বজের প্রতি জনা

(গ) উনিশ শতকের গীতিকবিতা
(সম্পাদনায়: অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)
১. শ্রাবণে – গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী
২. মাইকেল মধুসূদন দত্ত – নবীনচন্দ্র সেন
৩. অদ্ভুত অভিসার – দেবেন্দ্রনাথ সেন
৪. শতকণ্ঠে কর গান – শ্রীকৃষ্ণদাসী দত্তী
৫. শিক্ষা প্রতি – সম্পূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬. সাম্প্রতিক গানের শ্রেণিবিভাগের রূপরেখা

(ঘ) আধুনিক কবিতা:
জুতোনা – জীবনের পদসপ্তক
জসজিৎ মহারাজ লোকটা – মাইকেল চট্টোপাধ্যায়
শুধু তোকে ভালোবেসেছিলাম – এমন ভাব
লড়ে নার্ড – কবিতা মিস্স
পৃথিবী বাড়ুক রোজ – নবনীতা দেবসেন
উলঙ্গ রাজা – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

এখানে কয়েকটি প্রশ্নোত্তর উদাহরণ হিসেবে দেওয়া হল। সম্পূর্ণ সাজেশন PDF COPY খুব সহজে BUY করতে পারো।

(ক) কাব্যের রূপভেদ:

*****1) প্রশ্ন. মহাকাব্য কাকে বলে? মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলি উদাহরণসহ আলোচনা কর। (৫)

ভূমিকা:

কাব্যসাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারে মহাকাব্য এক গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন শাখা। মহাকাব্য শব্দটি শুনলেই মনে পড়ে বীরত্বগাথা, ধর্ম-নীতি, যুদ্ধ, দেব-মানবের লীলাকথা এবং মহাজীবনের মহাকাব্যিক রূপ। ভারতীয় সাহিত্যে যেমন রামায়ণ ও মহাভারত, পাশ্চাত্য সাহিত্যে তেমনই ইলিয়াড ও ওডিসি মহাকাব্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এইসব কাব্যে কেবল একক কাহিনি নয়, বরং একটি সমাজের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ধর্মবিশ্বাস এবং নৈতিক আদর্শ প্রতিফলিত হয়। মহাকাব্য একাধারে সাহিত্যিক সৌন্দর্যের উৎস, নৈতিক শিক্ষার আধার এবং অতীত ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল।

মহাকাব্য কাকে বলে?

মহাকাব্য হল এমন এক ধরণের বিশালাকারের কাব্য যেখানে কোনো জাতির ইতিহাস, ধর্ম, সমাজ, নীতি-আদর্শ, বীরত্ব এবং নৈতিক সংকট নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়। সাধারণত এই কাব্যগুলো ছন্দবদ্ধ হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে মুখে মুখে প্রচলিত থেকে পরবর্তীতে লিখিত আকার পায়। এই ধরণের কাব্য সাধারণত কোনও মহাবীরের জীবনকাহিনি, যুদ্ধ, ত্যাগ, প্রেম, নৈতিক দ্বন্দ্ব এবং সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি বহন করে। "মহা" মানে বৃহৎ বা মহান এবং "কাব্য" মানে সাহিত্যিক রচনা — সুতরাং "মহাকাব্য" হল এক বিশাল, গম্ভীর ও মহত্ত্বপূর্ণ কাব্যরূপ।

মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্য:

মহাকাব্য সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। নিচে মহাকাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করা হলো:

১. বিস্তৃত কাহিনি ও চরিত্রবিন্যাস: মহাকাব্যে সাধারণত দীর্ঘ কাহিনি থাকে। কাহিনির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন এক বা একাধিক নায়ক, যাঁদের জীবন এবং কর্ম-কান্ডের মাধ্যমে কাহিনি এগিয়ে চলে। সেই সঙ্গে থাকে অনেক পার্শ্বচরিত্র, উপ-কাহিনি এবং ঘটনাপ্রবাহ, যা মূল কাহিনিকে আরও সমৃদ্ধ করে।
উদাহরণ: মহাভারত কেবল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কাহিনি নয়; বরং এতে পাঁচ পাণ্ডব, কৌরব, কৃষ্ণ, দ্রৌপদী সহ বহু চরিত্রের জীবনের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে।

২. বীরত্ব ও যুদ্ধের বিবরণ: মহাকাব্যের অন্যতম অনিবার্য উপাদান হল বীরত্বপূর্ণ কর্ম ও যুদ্ধের বর্ণনা। এসব যুদ্ধ কেবল শারীরিক লড়াই নয়, বরং নৈতিক দ্বন্দ্ব, ন্যায়-অন্যায়ের সংঘর্ষ এবং আত্মত্যাগের প্রতীক।
উদাহরণ: ইলিয়াড-এ ট্রয় যুদ্ধের বর্ণনা, রামায়ণ-এ রাম ও রাবণের যুদ্ধ – সবই বীরত্বগাথা এবং নৈতিকতার দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ।

৩. দেবতা, দৈত্য ও অলৌকিক ঘটনার উপস্থিতি: মহাকাব্যে প্রায়শই দেবতা, দৈত্য, গন্ধর্ব, অপ্সরা, রাক্ষস প্রভৃতি অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত চরিত্রদের উপস্থিতি থাকে। এগুলির মাধ্যমে মানবজীবনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এক অদ্ভুত ও রহস্যময় জগত নির্মাণ করা হয়।
উদাহরণ: রামায়ণ-এ হনুমান, রাবণ, মেঘনাদ প্রভৃতি চরিত্রের অলৌকিক ক্ষমতা; মহাভারত-এ বিষ্ণু অবতার কৃষ্ণের লীলাকথা।

৪. নৈতিক আদর্শ ও ধর্মীয় উপদেশ: প্রত্যেক মহাকাব্য নৈতিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ। এখানে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, কর্তব্য-দায়িত্ব, আত্মত্যাগ, ভক্তি প্রভৃতি নীতির উপদেশ থাকে, যা পাঠককে জীবনের সঠিক পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করে।
উদাহরণ: রাম চরিত্রের আদর্শ রাজারূপে উপস্থাপন; যুধিষ্ঠিরের ধর্মপালন; গীতার নৈতিক দর্শন।

৫. কবিত্বশক্তির ব্যবহার ও ছন্দ: মহাকাব্য সাধারণত কবিতার ছন্দে রচিত হয় এবং ভাষা অত্যন্ত অলঙ্কারময় ও হৃদয়গ্রাহী। এতে রূপক, উৎপ্রেক্ষা, উপমা, অনুপ্রাস ইত্যাদি অলঙ্কারের প্রাচুর্য দেখা যায়।
উদাহরণ: রামচরিতমানস (তুলসীদাস) বা মেঘনাদবধ কাব্য (মধুসূদন দত্ত)-এ অলঙ্কারের অসাধারণ প্রয়োগ।

৬. জাতীয়তা ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি: প্রত্যেক মহাকাব্য একটি জাতির সংস্কৃতি, জীবনদর্শন, ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসের পরিচয় বহন করে। এতে ঐ জাতির নৈতিকতা, ধর্মীয় চর্চা এবং সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন ঘটে।
উদাহরণ: মহাভারত ও রামায়ণ ভারতীয় সমাজের নৈতিক আদর্শ, পারিবারিক সম্পর্ক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ তুলে ধরেছে।

৭. গম্ভীর ও উদাত্ত ভাব: মহাকাব্য সাধারণত গম্ভীর, উদাত্ত ও মহিমান্বিত রচনাশৈলীতে গঠিত। এটি পাঠকের মনে শ্রদ্ধা, বিস্ময় এবং গভীর ভাবনার সৃষ্টি করে।

৮. ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক ভিত্তি: মহাকাব্যের কাহিনিগুলি বাস্তব ইতিহাস ও পৌরাণিক ঘটনার মিশ্রণ হয়ে থাকে। এতে জাতির অতীত ইতিহাসের ছাপ থাকে এবং পৌরাণিক কাহিনির সাহায্যে জাতীয় চেতনাকে জাগ্রত করা হয়।

বিশ্বসাহিত্যে মহাকাব্যের কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ

নাম রচয়িতা/স্থান বিষয়
রামায়ণ বাল্মীকি (ভারত) রাম-রাবণের যুদ্ধ ও ধর্মপালন
মহাভারত বেদব্যাস (ভারত) কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ও ধর্মীয় দর্শন
ইলিয়াড হোমার (গ্রিস) ট্রয় যুদ্ধ এবং আখিলিসের বীরত্ব
ওডিসি হোমার (গ্রিস) ওডিসিউস-এর সমুদ্রযাত্রা ও ঘরে ফেরার কাহিনি
এনেইড ভার্জিল (রোম) ট্রয়ের পতনের পর এনিয়াস-এর অভিযান

বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্যের অবস্থান:
বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিক মহাকাব্যের সংখ্যা কম হলেও আধুনিক যুগে কিছু ব্যতিক্রমী সৃষ্টি হয়েছে যেগুলি মহাকাব্যিক গুণসম্পন্ন। যেমন:
মেঘনাদবধ কাব্য (মাইকেল মধুসূদন দত্ত): রাবণের পুত্র মেঘনাদের বীরত্বগাথাকে কেন্দ্র করে রচিত এই মহাকাব্যটি বাংলা সাহিত্যের গৌরব। এখানে রাবণ ও মেঘনাদকে ইতিবাচকভাবে দেখানো হয়েছে, যা প্রচলিত রামায়ণের বিপরীত।
বিজয়সংহিতা (নবীনচন্দ্র সেন): এই কাব্যে বাঙালি জাতির বীরত্ব ও আত্মত্যাগ তুলে ধরা হয়েছে।

উপসংহার: মহাকাব্য শুধুমাত্র একটি সাহিত্যধারা নয়; এটি একটি জাতির গৌরবময় ইতিহাস, মূল্যবোধ, নৈতিক আদর্শ এবং সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। মহাকাব্য পাঠের মাধ্যমে আমরা অতীতের বীরত্বগাথা, সমাজের রূপ এবং ধর্মীয় দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হই। রাম, অর্জুন, কৃষ্ণ, আখিলিস, এনিয়াস-এর মতো চরিত্র আমাদের সাহস, কর্তব্য ও নৈতিকতার পাঠ শেখায়। তাই বলা যায়, মহাকাব্য কেবল সাহিত্যিক সৌন্দর্য নয়, বরং মানবজীবনের এক পরিপূর্ণ দর্পণ।

(খ)বীরাঙ্গনা কাব্য

*****2) প্রশ্ন. 'নীলধ্বজের প্রতি জনা' পত্রিকায় জনা অর্জুন এবং পান্ডবদের যে যে কুকীর্তির কথা ব্যক্ত করেছেন, তা নিজের ভাষায় ব্যক্ত করো।৫

ভূমিকা:
বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে কল্পনার এক অভূতপূর্ব রূপান্তরের সাক্ষ্য বহন করেন লেখিকা ‘মহাশ্বেতা দেবী’। তাঁর সাহিত্য শুধু নান্দনিকতার সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সমাজচেতনার এক বলিষ্ঠ মাধ্যম। তাঁর রচিত‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’একটি প্রতীকি চিঠি যা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তা বহন করে। এখানে “জনা” নামক এক উপজাতি নারী, “নীলধ্বজ” নামে এক পৌরাণিক প্রতীককে উদ্দেশ করে লিখেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে প্রশ্ন তুলেছে পৌরাণিক যুগের গৌরবময় পুরুষদের নৈতিক চরিত্র এবং তাদের ক্ষমতালিপ্সার উপর। এই চিঠির মধ্য দিয়ে লেখিকা পৌরাণিক চরিত্র অর্জুন ও পান্ডবদের কর্মকাণ্ডকে উপজাতি দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করেছেন এবং তাদের কৃতকর্মের এক অসাধারণ সমালোচনা তুলে ধরেছেন। এটি একরকম পুনর্পাঠ বা ডিকনস্ট্রাকশন, যেখানে জনা প্রশ্ন তুলেছে — নায়কের সংজ্ঞা কে ঠিক করে? ইতিহাসের 'নায়ক' কি সবসময়ই ন্যায়ের প্রতীক?

অর্জুনের কুকীর্তি:
পৌরাণিক চরিত্র অর্জুনকে সাধারণত বীর, দক্ষ যোদ্ধা এবং ন্যায়ের রক্ষক হিসেবেই চিত্রিত করা হয়। কিন্তু জনা এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। সে অর্জুনের একাধিক কর্মকাণ্ডকে ন্যক্কারজনক এবং দুর্বৃত্তের আচরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তার বর্ণনায় অর্জুন কেবলমাত্র একজন 'শিকারি'। যে গর্ব করে বলে — “আমি হাজার নারীর সঙ্গে সহবাস করেছি।” জনা প্রশ্ন তোলে — এই অহংকার কি কোনো নৈতিকতার? নাকি এটি একজন পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার চরম আত্মম্ভরিতা? জনার মতে, অর্জুনের আসল পরিচয় একজন 'ধর্ষক' হিসেবে। বিশেষ করে তিনি যেভাবে উপজাতি নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালিয়েছেন — তা এক গভীর মানবিক অপরাধ। জনা মনে করেন, অর্জুন কখনও এইসব নারীর সম্মতি নিয়েছেন না — বরং তিনি শাসকের শক্তি ও পৌরাণিক ন্যায়ের ছদ্মবেশে তাদের দেহে আগ্রাসন চালিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে লেখিকা মূলত পৌরাণিক পুরাণগুলিতে নারী চরিত্রদের নীরবতা ও তাদের ভোগ্য বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হবার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। জনা প্রশ্ন তোলে — “আমাদের জাতির মেয়েদের শরীর যেন কীভাবে হয়ে উঠল পুরুষ বীরদের মস্তির জায়গা?” জনার দৃষ্টিতে অর্জুন এমন একজন পুরুষ যিনি নিজের কামনা চরিতার্থ করার জন্য উপজাতি মেয়েদের ব্যবহার করেছেন। অর্জুনের পৌরাণিক মর্যাদার পেছনে লুকিয়ে আছে নারীর প্রতি অবমাননা ও ভোগবাদী মনোভাব।

পাণ্ডবদের কুকীর্তি:
জনা শুধু অর্জুনকেই নয়, বরং পুরো পান্ডব ভাইদেরই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, পাণ্ডবরা “দারুণ ন্যায়পরায়ণ, ধার্মিক” এমন ভাবমূর্তির আড়ালে লুকিয়ে আসলে একজন একনায়ক, অত্যাচারী ও ক্ষমতালোভী শক্তি। বিশেষ করে দ্রৌপদীকে পাশার খেলায় জুয়া বস্তু হিসেবে ব্যবহার করে অপমানিত করার যে ঘটনা — জনার দৃষ্টিতে সেটি নিছক নারীর উপর পিতৃতান্ত্রিক প্রতিপত্তি দেখানোর এক উদাহরণ। জনা বলেন, “তোমরা যে নিজের স্ত্রীকে বাজি রেখেছিলে — সেই অপরাধকে কোনো ধর্ম দিয়েই বৈধ করা যায় না।” এখানে লেখিকা পিতৃতান্ত্রিক ধর্মব্যবস্থার ভণ্ডামির প্রতি তীব্র আক্রমণ করেছেন। জনার যুক্তি — যেসব মানুষ নিজেদের স্ত্রীকেও রক্ষা করতে অক্ষম, তারা সমাজ রক্ষার দাবি কিভাবে করে? এছাড়াও, জনা অভিযোগ করেন, পান্ডবরা যুদ্ধে বিজয়লাভের পর কখনও সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট, উপজাতিদের নিরাপত্তা কিংবা নারীদের অধিকার নিয়ে ভাবেনি। বরং তারা কেবলমাত্র ‘রাজ্য’ দখলের রাজনীতি ও প্রতিশোধপরায়ণতাকে প্রাধান্য দিয়েছে। যুদ্ধের নামে হত্যা, নিপীড়ন, ধর্ষণ ও লুটতরাজ হয়েছে — কিন্তু কেউ কখনও সেই 'জয়' এর মূল্য প্রশ্ন করেনি।

উপজাতি দৃষ্টিকোণ এবং কেন্দ্রবিরোধিতা:
এই চিঠির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য — এটি একটি মার্জিনাল ভয়েস বা প্রান্তিক কণ্ঠস্বর। জনা একজন উপজাতি নারী — যাঁর দৃষ্টিভঙ্গি মূলধারার পৌরাণিক বর্ণনাকে চ্যালেঞ্জ করে। এখানে 'নীতিরক্ষক' আর 'অপরাধী'র সীমারেখা অনেকটাই মুছে যায়। জনার কাছে অর্জুন বা পাণ্ডবরা মহান নয় — বরং একদল অত্যাচারী ক্ষমতালোভী পুরুষ। এমনকি, তিনি প্রশ্ন করেন — পৌরাণিক দেবতা বা নীলধ্বজ নিজেই কি এক ন্যায়ের প্রতীক? নাকি তিনি শুধুই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতিমূর্তি? এইভাবে লেখিকা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় আধিপত্যবাদের প্রবল সমালোচনা করেন। জনা কেবল অর্জুনদের আক্রমণ করেন না, বরং সেই সমাজব্যবস্থাকেই আক্রমণ করেন, যা এই ধরনের চরিত্রদের মহান বলে ঘোষণা করে।

নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি:
এই চিঠি মূলত নারীবাদী মনোভাবের এক নিদর্শন। জনার চোখে পুরুষরা শুধু বিজয়ের কথা বলে, কিন্তু নারীর প্রতি সম্মান, অনুভূতি কিংবা স্বাধীনতা নিয়ে তারা কখনও ভাবে না। জনা জিজ্ঞাসা করে — “আমি কি কেবলই সন্তান উৎপাদনের এক যন্ত্র? আমার শরীর কি শুধু দখল করার বস্তু?” এই সমস্ত প্রশ্ন নারীর আত্মপরিচয় এবং স্বাধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্জুনের হাজার স্ত্রী থাকা, দ্রৌপদীর মতো একজন বুদ্ধিমতী নারীর বারবার অবমানিত হওয়া, এইসবই জনার কাছে ‘পুরুষতন্ত্রের বীরগাঁথা’ ছাড়া কিছু নয়। তিনি বলেন — “তোমরা নায়ক হয়েছো, কারণ তোমাদের কাহিনি যারা লিখেছে, তারাও তোমাদের মতোই পুরুষ।”

ঐতিহাসিক পুনর্পাঠ এবং বিকল্প ইতিহাসের প্রয়াস:
‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ চিঠিতে মহাশ্বেতা দেবী যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন, তা একপ্রকার ঐতিহাসিক পুনর্মূল্যায়নের প্রয়াস। লেখিকা দেখাতে চেয়েছেন যে, ইতিহাস মানে কেবল রাজার কীর্তিগাথা নয়, বরং সাধারণ মানুষের বেদনা, শোষণ এবং প্রতিরোধের কথাও ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। এই চিঠিতে জনা একজন সাধারণ উপজাতি নারী — কিন্তু তার আত্মসম্মানবোধ এবং ন্যায়বোধ অসাধারণ। সে জানে, সে ইতিহাস লেখে না — তবুও ইতিহাসকে প্রশ্ন করতে পারে। এই সাহসী কণ্ঠই প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি।

উপসংহার:
মহাশ্বেতা দেবীর‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’শুধু একটি পত্র নয়, এটি একটি প্রতিবাদ, একটি চেতনার আহ্বান। এখানে জনা অর্জুন ও পান্ডবদের পৌরাণিক মহিমা খণ্ডন করে তাঁদের মানবিক ত্রুটি, বিশেষ করে নারীর প্রতি নিপীড়ন এবং ক্ষমতা-লালসার মুখোশ উন্মোচন করেন। এটি এক গভীর রাজনৈতিক ও নারীবাদী বয়ান, যা ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনিকে প্রান্তিক মানুষের চোখে নতুন করে দেখার আহ্বান জানায়। এই ধরনের সাহিত্যের প্রয়োজন রয়েছে আজকের সমাজেও — যেখানে ইতিহাসকে শুধু জয়ী পক্ষের নয়, পরাজিত, নির্যাতিত এবং প্রান্তিক কণ্ঠের দিক থেকেও বিশ্লেষণ করা হয়। জনা সেই কণ্ঠস্বর — যে ইতিহাসে জায়গা না পেয়েও ইতিহাসকে প্রশ্ন করতে শেখায়।

(গ) উনিশ শতকের গীতিকবিতা

*****3) প্রশ্ন. ‘শ্রাবণে’ কবিতায় শ্রাবণ মাসের কোন কোন প্রসঙ্গ কবি তুলে ধরেছেন? কবিতার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করো। (৫)

ভূমিকা:
উনিশ শতকের গীতিকবিতা বাংলা সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়কার কবিরা প্রকৃতি, প্রেম, বিরহ, স্মৃতি ও হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে গীতিময় ভাষায় প্রকাশ করেছেন। গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী এই ধারার একজন বিশিষ্ট কবি। তাঁর ‘শ্রাবণে’ কবিতাটি শ্রাবণ মাসের প্রকৃতি, প্রেমের না-পাওয়া বেদনা ও হৃদয়াবেগের এক অপূর্ব সমন্বয়। কবিতাটিতে তিনি এমন এক আবহ তৈরি করেছেন, যেখানে প্রকৃতির রূপের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ের নিঃসঙ্গতা ও আকুলতা অনুভব করা যায়।

শ্রাবণ মাস ও প্রকৃতির বর্ণনা:
‘শ্রাবণে’ কবিতার শুরুতেই কবি শ্রাবণ মাসের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। বাংলা বর্ষার অন্যতম সময় শ্রাবণ মাস। এসময় আকাশে কালো মেঘ, দিনের পর দিন বৃষ্টি, নদীর জল বাড়া এবং পাখিদের ডাক—সব মিলিয়ে এক বিশেষ অনুভূতির পরিবেশ তৈরি হয়। কবি বলেন—
“শ্রাবণে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কভু—
শ্রাবণমেঘে জল ছিল, চখাচখি ডাকত নদীতে।”
এই পঙক্তিগুলিতে আমরা পাই শ্রাবণমাসের একটি নৈসর্গিক দৃশ্যপট। শ্রাবণের আকাশে ভেসে বেড়ানো কালো মেঘ, নদীতে চখাচখি পাখির ডাক—সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন প্রেম ও আবেগের এক জীবন্ত রূপে ফুটে ওঠে। কিন্তু এই রূপের মাঝেও কবির মনে একরাশ না-পাওয়ার হাহাকার।

চিত্রকল্পে আবেগ প্রকাশ:
গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী কবিতার চিত্রকল্প নির্মাণে পারদর্শী। শ্রাবণের প্রকৃতিকে তিনি নিছক প্রকৃতি হিসেবে দেখেননি, বরং তার মধ্যে এক গভীর হৃদয়মথিত অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত করেছেন। মেঘ, বৃষ্টি, নদী, পাখির ডাক—সব কিছুই যেন কবির মনে এক পুরোনো অভিজ্ঞতার স্মৃতি ফিরিয়ে আনে।
প্রিয়জনের অনুপস্থিতিতে শ্রাবণ যেমন তার সৌন্দর্য হারায়, তেমনি কবির হৃদয়ও নিঃসঙ্গতায় ভরে ওঠে। প্রকৃতি এখানে নিছক পটভূমি নয়, বরং একান্ত মানসিক যন্ত্রণার সহচর।

প্রেম ও বিচ্ছেদ:
কবিতার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে প্রেম এবং তার না-পাওয়ার কষ্ট। কবি জানাচ্ছেন, শ্রাবণ এসেছে, কিন্তু সেই সময়ে প্রিয়জনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। এখানেই ফুটে উঠেছে বিরহের চিরন্তন অনুভব।
“তবুও শ্রাবণ আসে, যায়; চেনা চখাচখি ডাকতে থাকে নদীতে—
চেনা শ্রাবণমেঘে জল নামে—
তোমার চোখের মতো বৃষ্টিতে।”
এই লাইনগুলোতে ‘তোমার চোখের মতো বৃষ্টিতে’ বাক্যাংশটি পাঠকের মনে এক গভীর আবেগের সৃষ্টি করে। কবি বৃষ্টির জলে প্রিয়জনের চোখের অশ্রুর প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান। এখানে কবির দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে আবেগনির্ভর, যেখানে প্রকৃতি ও মানব-সম্পর্ক এক গভীর তাত্ত্বিক ও রূপকাত্মক অর্থে মিলেমিশে যায়।

স্মৃতি ও পুনরাগমনের ব্যর্থতা:
শ্রাবণ প্রতিবার আসে, কিন্তু সেই দেখা আর হয় না। এই অনুপস্থিতি বারবার কবিকে অতীতের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করে। কবির মনে পড়ে সেইসব দিনের কথা, যখন অপেক্ষা ছিল, আকাঙ্ক্ষা ছিল, কিন্তু মিলন হয়নি।
প্রতিবার শ্রাবণ ফিরে আসে, কিন্তু সম্পর্কের পূর্ণতা আসে না। এই পুনরাবৃত্ত অনুপস্থিতি কবির হৃদয়ে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তা ধীরে ধীরে দগদগে হয়ে ওঠে। তাই শ্রাবণের প্রতিটি দিন, প্রতিটি বৃষ্টি যেন কবিকে আরও একাকী করে তোলে।

প্রকৃতি ও হৃদয়ের মেলবন্ধন:
গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর কবিতায় প্রকৃতি কেবল পটভূমি নয়—বরং তা কবির হৃদয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। কবি প্রকৃতিকে অনুভব করেন, তাঁর মানসিক অবস্থাকে প্রকৃতির উপাদান দিয়েই প্রকাশ করেন। শ্রাবণমেঘ, নদী, চখাচখি পাখি—সবকিছুই যেন তাঁর অন্তরের কথা বলে।
এই রকম আবেগপ্রবণ গীতিকবিতার মাধ্যমে পাঠক নিজেও কবির সেই আবেগে একাত্মতা অনুভব করেন। প্রকৃতি ও মানবচেতনার এই মিলনই গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর কবিতাকে আরও বেশি হৃদয়স্পর্শী করে তোলে।

নারী-কণ্ঠের আত্মদর্শন:
গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ছিলেন একজন মহিলা কবি, যা উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে ছিল অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ। তাঁর কবিতায় নারীর একান্ত অনুভব, প্রেম, আকাঙ্ক্ষা ও নিঃসঙ্গতার যে প্রকাশ ঘটেছে, তা নিছক কল্পনা নয়—বরং এক বাস্তব অভিজ্ঞতার ছায়া।
‘শ্রাবণে’ কবিতাটিও সেই ব্যক্তিগত আবেগময়তারই এক দৃষ্টান্ত। এখানে কবি কেবল একজন প্রেমিকা নন, বরং একজন মানুষ, যিনি সময়, প্রকৃতি ও সম্পর্কের জটিলতাকে হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে উপলব্ধি করছেন।

বিরহের ভাষা ও কাব্যিক শৈলী:
এই কবিতায় ব্যবহৃত ভাষা অত্যন্ত সহজ, কিন্তু তাতে রয়েছে এক অন্তর্গত আবেগ। অলংকার ব্যবহারে কবি কৃপণ নন, তবে অযথা অলংকারের বাহুল্য নেই। বিশেষ করে ‘তোমার চোখের মতো বৃষ্টিতে’—এই এক লাইনে তিনি অলংকার ও আবেগের যে চূড়ান্ত রূপ দিয়েছেন, তা এক অসাধারণ কাব্যিক অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
তার চিত্রকল্প নির্মাণ এমনই গভীর যে পাঠক নিজের জীবনের স্মৃতির সঙ্গে মিল খুঁজে পান। বিরহ এখানে ব্যক্তিগত হয়েও সর্বজনীন হয়ে উঠেছে।

উপসংহার:
‘শ্রাবণে’ কবিতায় গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তা শুধুমাত্র একটি ঋতুর রূপ নয়—বরং একটি অনুভূতির নাম। কবিতাটি আমাদের বোঝায়, কিভাবে প্রকৃতি ও মানসিক অবস্থার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। শ্রাবণ এখানে প্রেম, স্মৃতি, না-পাওয়া, নিঃসঙ্গতা এবং অভিমানের এক মূর্ত প্রতীক।
প্রত্যেক পাঠকের জীবনে কিছু শ্রাবণ থাকে—যেখানে দেখা হয় না, কথা হয় না, কিন্তু প্রকৃতি সেই না-পাওয়ার সাক্ষী হয়ে থাকে। কবিতাটির প্রতিটি পঙক্তি যেন একটি করে অনুভূতির অনুবাদ। শ্রাবণের বৃষ্টি, মেঘ, নদী, চখাচখি—সবই কবির না-পাওয়ার যন্ত্রণার সাক্ষ্য বহন করে।
অতএব, বলা যায় ‘শ্রাবণে’ কবিতাটি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর এক অনবদ্য সৃষ্টি, যেখানে প্রেম ও প্রকৃতি মিলেমিশে এক নিঃশব্দ বিষাদগাথা রচনা করেছে। এই কবিতা পাঠকের মনে প্রেমের গভীরতা, না-পাওয়ার কষ্ট ও স্মৃতির আবেগময় আলোড়ন সৃষ্টি করে।

(ঘ) আধুনিক কবিতা:

*****4) প্রশ্ন. "পৃথিবীর গভীরতম অসুখ এখন, মানুষ তবু ঋণী পৃথিবীর কাছে।" — এই পঙ্ক্তিটি কার লেখা ও কোন কবিতার অংশ? উদ্ধৃত অংশের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর। (৫)

ভূমিকা:
কবিতা সাহিত্যের এমন এক মাধ্যম, যার মাধ্যমে জীবনের গভীরতম অনুভব ও উপলব্ধিকে প্রকাশ করা যায় সংক্ষিপ্ত অথচ শক্তিশালী শব্দচয়নের মাধ্যমে। মানবজাতির সংকট, ব্যথা, আশা, অনুশোচনা কিংবা দায়বদ্ধতা — এসবই কবিতার পঙ্ক্তিতে বারবার উঠে এসেছে। আধুনিক কবিতায় মানুষের অস্তিত্বজিজ্ঞাসা ও মানবিক দায়বোধ খুব গুরুত্ব সহকারে ধরা পড়ে। উল্লিখিত পঙ্ক্তিটি বর্তমান সময়ের এক জটিল বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে গভীর সংবেদনায়।

উদ্ধৃত পঙ্ক্তির পরিচয়:
"পৃথিবীর গভীরতম অসুখ এখন,
মানুষ তবু ঋণী পৃথিবীর কাছে।" — এই দুটি পঙ্ক্তি বিশিষ্ট কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘ঋণ’ নামক কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। কবিতাটি তাঁর কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত এক উল্লেখযোগ্য রচনার অংশ। এই কবিতায় কবি বর্তমান সময়ের এক জটিল দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধহীনতা তুলে ধরেছেন, যেখানে মানুষের নির্মমতা, ভোগবাদ ও স্বার্থপরতার মাঝেও প্রকৃতির কাছে তার ঋণ অমোচনীয় রয়ে গেছে।

কবির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গভীর চিন্তাশীল ও অন্তর্মুখী কবি। তিনি তাঁর কবিতায় সময়ের গভীর অসুখ, সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব, মানুষের আত্মিক খরা ও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য — এই দুইয়ের বিপরীত মেরুকে একত্রে বুনে দেন। তাঁর ভাষা সংযত, অনুভব গভীর এবং ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ। ‘ঋণ’ কবিতাটিও এই ধারাবাহিকতার অংশ।

কবিতার প্রেক্ষাপট ও ভাবনা বিশ্লেষণ:
এই কবিতায় কবি বিশ্বজুড়ে বিরাজমান নৈতিক ও মানসিক বিপর্যয়ের কথা বলেছেন। আমাদের সময় এখন এক ধরনের গভীর অসুখে আক্রান্ত — যে অসুখ কেবল শারীরিক নয়, বরং মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, দারিদ্র্য, বৈষম্য, পরিবেশ ধ্বংস, প্রযুক্তির দাসত্ব — সব মিলিয়ে মানুষের জীবন আজ এক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত। কবি এই ‘গভীরতম অসুখ’-এর কথা বলেন, যা মনুষ্যত্বকেও গ্রাস করেছে।

তবু, এত সব অশান্তির মধ্যেও কবি মনে করিয়ে দেন — “মানুষ তবু ঋণী পৃথিবীর কাছে।” অর্থাৎ মানুষ যতই স্বার্থপর হোক না কেন, সে এক মহামায়ার কাছে চিরঋণী — সেই মহামায়া হচ্ছে এই পৃথিবী। কারণ, এই পৃথিবী তাকে আশ্রয় দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে, জল, আলো, বাতাস দিয়েছে। তার অস্তিত্বই পৃথিবীর দানে গঠিত। অথচ মানুষ সেই পৃথিবীকে ধ্বংস করছে প্রতিনিয়ত — গাছ কেটে, নদী দুষিত করে, প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষ করে, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে।

এখানে কবি এক প্রকার আত্মসমালোচনার ভঙ্গিতে মানবজাতিকে অনুশোচনাপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখে বলেন — পৃথিবী অসুস্থ, তার প্রাণহীনতার জন্য মানুষই দায়ী, তবু মানুষকে তারই কাছে ঋণী হয়ে থাকতে হয়।

উদ্ধৃত অংশের তাৎপর্য:
উদ্ধৃত পঙ্ক্তির গভীরে রয়েছে এক দার্শনিক বোধ। প্রথম পঙ্ক্তি “পৃথিবীর গভীরতম অসুখ এখন,” — এখানে ‘অসুখ’ শব্দটি কেবল শারীরিক নয়, এটি একটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত। এটি বোঝায় পৃথিবীর বর্তমান বৈশ্বিক অবস্থান — যেখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ, মৌলবাদ, পরিবেশ ধ্বংস, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ এবং নৈতিকতার অবক্ষয় চলছে।

এই সময়ের পৃথিবী যেন এক ক্লান্ত ও অসুস্থ শরীর — যাকে আরাম দেওয়া তো দূরের কথা, বরং মানুষ তার ক্ষতকে প্রতিদিন আরও বাড়িয়ে তুলছে। তাই এটি ‘গভীরতম অসুখ’ — শুধুমাত্র রোগ নয়, এটি মানবিকতার, বিবেকের, মূল্যবোধের ও প্রকৃতির অসুখ।

দ্বিতীয় পঙ্ক্তি — “মানুষ তবু ঋণী পৃথিবীর কাছে।” এই লাইনটি একধরনের আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মদায়বোধ তৈরি করে। কবি বোঝাতে চেয়েছেন, পৃথিবীর কাছে মানুষের রয়েছে এক চিরন্তন ঋণ। মানুষ সভ্যতার নামে ধ্বংস ডেকে আনছে, তবু তার অস্তিত্ব এই পৃথিবীর ওপরই নির্ভরশীল। এটি এমন এক সত্য, যাকে অস্বীকার করা যায় না।

এই লাইন যেন পাঠকের মনে এক ধাক্কা দিয়ে প্রশ্ন তোলে — আমরা কি আমাদের ভূমিকার প্রতি সত্যিই সচেতন? আমরা কি জানি, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে আসলে আমরা নিজেদেরই ধ্বংস করছি?

শিল্পরূপ ও অলংকার:
এই কবিতায় কবি দুটি ছোট পঙ্ক্তির মাধ্যমে এক গভীর অর্থ বহন করেছেন। পঙ্ক্তিগুলিতে রয়েছে উপমা ও রূপকের মিশ্র প্রয়োগ। ‘গভীরতম অসুখ’ – এটি একটি রূপক, যা পৃথিবীর সমস্ত সমস্যা, ক্লেশ ও সংকটকে একত্রে চিত্রিত করেছে। পাশাপাশি ‘ঋণী’ শব্দের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে মানবিক দায়িত্ববোধ ও আত্মসমালোচনার সুর। এই কবিতার ভাষা সহজ হলেও তার ভাব গভীর ও চিন্তনীয়।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা:
এই কবিতার বার্তা আজকের দিনে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আজ পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় পরিবেশ বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, হিমবাহ গলে যাওয়া, বনভূমি উজাড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ — এসব যেন একে একে পৃথিবীর ‘অসুখ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যতই এগিয়ে যাক না কেন, সে প্রাকৃতিক শক্তির সামনে চিরকালই অসহায়।

এই পরিস্থিতিতে কবির বাণী আমাদের মনে করিয়ে দেয় — আমরা পৃথিবীকে যেমন ব্যবহার করছি, তেমনই তার প্রতিফল পেতে বাধ্য হব। পৃথিবী আমাদের জন্ম দিয়েছে, প্রতিপালন করেছে, তবু আমরা তার প্রতিরক্ষায় ব্যর্থ। তাই এই ‘ঋণ’ শুধু আর্থিক বা বস্তুর নয়, এটি এক নৈতিক ঋণ — যা কখনো শোধ করা সম্ভব নয়, কেবল স্বীকার করা যায়।

মানবিক দায়বদ্ধতা ও দায়:
এই পঙ্ক্তি পাঠকের মনে একধরনের নৈতিক আত্মজিজ্ঞাসা জাগিয়ে তোলে। কবির লক্ষ্য কেবল প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি দায়বোধ নয়, বরং মানবিক সম্পর্ক, সভ্যতার ভবিষ্যৎ, অর্থনৈতিক অসমতা, যুদ্ধ-শান্তির ভাবনা সবকিছুকে একসাথে বিবেচনা করা।

যতদিন আমরা বুঝতে না পারি যে, এই পৃথিবী আমাদের মা, আমাদের আশ্রয় — ততদিন আমরা আমাদের আসল পরিচয় খুঁজে পাব না। তাই এই পঙ্ক্তি এক সামাজিক, নৈতিক ও দার্শনিক বার্তা বহন করে।

উপসংহার:
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "ঋণ" কবিতার এই পঙ্ক্তিগুলি আজকের সমাজে এক জাগরণের ডাক। মানুষ যতই উন্নত হোক, যতোই আধুনিক হয়ে উঠুক না কেন — তার অস্তিত্ব প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। এই পঙ্ক্তির মধ্যে দিয়ে কবি এক অনন্য সংবেদনশীলতা, দায়বদ্ধতা এবং আত্মসমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। কবিতাটি আমাদের শেখায় — পৃথিবী অসুস্থ, কিন্তু সেই অসুস্থতার দায় আমাদের। তবু, সেই পৃথিবীর কাছেই আমরা চিরকাল ঋণী।

এই পঙ্ক্তির মাধ্যমে কবি মানবজাতিকে শুধুই দায়ী করেননি, বরং এক নবজাগরণের আহ্বান রেখেছেন — আমরা যেন বুঝতে পারি, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে পৃথিবীকে ভালোবাসা, রক্ষা করা ও কৃতজ্ঞ থাকা একান্ত প্রয়োজন। এই ভাবনা এবং বোধই কবিতাটিকে সময়ের সেরা বার্তাবাহক করে তোলে।

এখানে কয়েকটি প্রশ্নোত্তর উদাহরণ হিসেবে দেওয়া হল। সম্পূর্ণ সাজেশন PDF COPY খুব সহজে BUY করতে পারো।

Bengali Major 1st Paper 401 Nep Suggestion