Kalyani University Suggestion
Kalyani University B.A 4th Semester History Minor Nep Suggestions 2025
মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস / History of Medieval India
Kalyani University B.A 4th Semester History Minor NEP ছোট প্রশ্ন, বড়ো প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন PDF টি পেতে.. আপনি 150 টাকা পেমেন্ট করুন। পেমেন্টের পর এক সেকেন্ডের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাজেশনটি পাবেন। ধন্যবাদ। টাকা টি পেমেন্ট করার জন্য নিচে PAY বাটনে ক্লিক করুন।
অথবা আপনি চাইলে সরাসরি PhonePe-এর মাধ্যমে 150 টাকা পেমেন্ট করে সাজেশন সংগ্রহ করতে পারেন। PhonePe নম্বর: 6295668424 (পেমেন্টের পর স্ক্রিনশট হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালে PDF COPY পাঠিয়ে দেব।)
My Phone Number- 6295668424
• এই সাজেশনের বড়ো প্রশ্ন সংখ্যা 30 টি।
ছোট প্রশ্ন প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন পাবেন।
• নিরক্ষরেখে বলতে পারি এই সাজেশনেরর বাইরে কোন প্রশ্ন উত্তর আসবে না।
• ১০০% তোমরা কমন পাবে।
• এই সাজেশনের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সিলেবাস অনুযায়ী এবং ইউনিট
অনুযায়ী সাজানো রয়েছে ।
• তোমরা চাইলে খুব সহজে BUY করতে পারো।
• THANK YOU.
এখানে অল্প কিছু প্রশ্নোত্তর আপলোড করা হয়েছে যদি তোমার মনে হয় সাজেশনটি BUY করতে পারো ।
মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস / History of Medieval India
(সিলেবাস – ২০২৫)
Unit–1:
সুলতানি শাসনের অধীনে উত্তর ভারত (১২০৬–১২৮৬ খ্রিঃ) — সুলতানি সাম্রাজ্যের বিস্তার, খলজি বিপ্লব ও খলজি সাম্রাজ্যের উত্থান; তুঘলক শাসনের সংস্কার ও পাল্টা সংস্কার; বিজয়নগর, বাহমনি ও বাংলার উত্থান; সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন; সমাজ, অর্থনীতি, শিল্পকলা, স্থাপত্য ও সাহিত্য।
Unit–2:
মুঘলদের উত্থানের প্রেক্ষাপট — দিল্লিতে তৈমুরের আক্রমণ, সৈয়দ ও লোদিদের শাসন; বাবরের ভারত আক্রমণ ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ; হুমায়ুনের ব্যর্থতা; শেরশাহের শাসন ও আফগান প্রশাসন; পরবর্তী মুঘল সাম্রাজ্য: আকবর থেকে ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত রাষ্ট্র নির্মাণ।
Unit–3:
জায়গির সংকট ও কৃষি সংকট; মুঘল সাম্রাজ্যের পতন; আঞ্চলিক রাজনীতির বিকাশ; শিবাজির নেতৃত্বে মহারাষ্ট্র ও পেশোয়া প্রশাসন; বাংলা, অযোধ্যা, মহীশূর ও হায়দরাবাদের রাষ্ট্রসমূহের উত্থান।
Unit–4:
মুঘল সাম্রাজ্যের সামগ্রিক মূল্যায়ন — রাষ্ট্র ও ধর্ম, প্রশাসনিক কাঠামোর মূল্যায়ন; মনসবদারি ও জায়গির ব্যবস্থা; ভূমি ও কৃষি ব্যবস্থাপনা; শহরের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য; ব্যবসা ও শিল্প; সমাজ ও সংস্কৃতি; জনসাধারণের ধর্মচর্চা; ভাষা, সংগীত, সাহিত্য, শিল্পকলা ও স্থাপত্যের বিকাশ।
এখানে কয়েকটি প্রশ্নোত্তর উদাহরণ হিসেবে দেওয়া হল। সম্পূর্ণ সাজেশন PDF COPY খুব সহজে BUY করতে পারো।
Unit–1: সুলতানি শাসনের অধীনে উত্তর ভারত
*****1) প্রশ্ন. বাজারদর নিয়ন্ত্রণে আলাউদ্দিন খিলজি কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন? ১০/৫ অথবা, আলাউদ্দিন খিলজির মূল্যনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর।
ভূমিকা:
ভারতের মধ্যযুগীয় ইতিহাসে দিল্লি সালতানাতের শাসকদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী শাসক ছিলেন আলাউদ্দিন খিলজি (শাসনকাল: ১২৯৬–১৩১৬ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি খিলজি বংশের দ্বিতীয় সুলতান হিসেবে কেবল যুদ্ধজয়ী সেনাপতি নন, বরং এক দক্ষ প্রশাসক ও সমাজসংস্কারক হিসেবেও পরিচিত। তাঁর শাসনামলে রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। আলাউদ্দিন খিলজির বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল সাধারণ জনগণের কল্যাণ সাধন, সেনাবাহিনীর জন্য সুলভ মূল্যে রসদের ব্যবস্থা করা, এবং মজুতদার ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের দমন করা। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হন, অন্যদিকে সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাও নিশ্চিত করেন।
আলাউদ্দিন খিলজির বাজার নিয়ন্ত্রণের পটভূমি:
সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির শাসনকাল ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বহির্শত্রুর হুমকিতে পরিপূর্ণ। মোঙ্গলদের একের পর এক আক্রমণ, রাজ্যজয়ের ধারাবাহিকতা এবং বিশাল সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন ছিল। সেই অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে সাধারণ জনগণের ওপর বোঝা না চাপিয়ে অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা আনার এক দুরূহ কাজ তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করেন। এই প্রেক্ষাপটে তিনি বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
১. মূল্যনির্ধারণ:
আলাউদ্দিন খলজি বাজারদরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রথমত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেন। তিনি চাল, গম, ডাল, চিনি, ঘি, মাংস, কাপড়, এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের নির্ধারিত দাম বেঁধে দেন। এই মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে তিনি ব্যবসায়ীদের অনৈতিক মুনাফা অর্জনের সুযোগ কমিয়ে আনতে সক্ষম হন। সুলতান নিজে এই মূল্যের উপর কড়া নজরদারি করতেন যাতে কোনো ব্যবসায়ী নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে না পারে। সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
উদাহরণস্বরূপ:
• চাল প্রতি মণ ৭২ দাম
• গম প্রতি মণ ৫১ দাম
• ঘি প্রতি সের ২ দাম
• রেশমের কাপড় প্রতি গজ ১০ দাম
এই নির্ধারিত মূল্যের বাইরে পণ্য বিক্রয় করলে কঠোর শাস্তির বিধান ছিল। এই পদক্ষেপ মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য রোধে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়।
২. গুদাম এবং বিতরণ ব্যবস্থা:
আলাউদ্দিন খলজি বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য গুদাম এবং বিতরণ ব্যবস্থা স্থাপন করেন। দিল্লিতে তিনি একটি কেন্দ্রিয় গুদাম স্থাপন করেন যেখানে সমস্ত পণ্য মজুদ করা হতো এবং সেখান থেকে তা বিতরণ করা হতো। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি পণ্যের অভাব এবং মূল্য বৃদ্ধির সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হন।
৩. নজরদারি এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা:
বাজারদর নিয়ন্ত্রণে আলাউদ্দিন খলজি কঠোর নজরদারি এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি বাজারে নিয়মিত গোয়েন্দা পাঠাতেন যারা বাজারের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন এবং কোনো ব্যবসায়ী নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। এই শাস্তির মধ্যে জরিমানা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং প্রয়োজনে কারাদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল।
৪. মজুতদারি নিষিদ্ধ:
আলাউদ্দিন খলজি মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ব্যবসায়ীরা যাতে পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে, সে জন্য সুলতান মজুতদারি নিষিদ্ধ করেন। যদি কোনো ব্যবসায়ী মজুতদারির সাথে জড়িত থাকত, তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো।
৫. পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন:
আলাউদ্দিন খলজি পণ্য পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নেও মনোনিবেশ করেন। তিনি সড়ক এবং পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়ন করেন যাতে পণ্য দ্রুত এবং নিরাপদে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছাতে পারে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করেন এবং বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখেন।
৬. রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার:
বাজারদর নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আলাউদ্দিন খলজি রাজস্ব ব্যবস্থারও সংস্কার করেন। তিনি কর আদায়ের পদ্ধতি সহজ এবং কার্যকর করেন যাতে কৃষক এবং সাধারণ জনগণের উপর করের বোঝা কমে। রাজস্ব ব্যবস্থার এই সংস্কারের ফলে কৃষকরা সুষ্ঠু পরিবেশে উৎপাদন কার্য চালাতে পেরেছেন এবং পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৭. সেনাবাহিনীর জন্য রেশনিং ব্যবস্থা:
একটি বড় সেনাবাহিনীর রসদ জোগানো সহজ কাজ নয়। তাই আলাউদ্দিন সেনাদের জন্য আলাদা সরকারি রেশনিং ব্যবস্থা চালু করেন। বাজার থেকে না কিনে সরাসরি সরকারি গুদাম থেকে সেনারা রেশন পেত। এতে বাজারে চাপ কমে এবং পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকে।
৮. রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার:
আলাউদ্দিন রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার করে কৃষিজ উৎপাদনের উপর নির্ভরতা বাড়ান এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমান। কৃষকেরা সরাসরি সরকারের অধীনে কর দিত, ফলে তারা লাভবান হতো এবং উৎপাদনও বেড়ে যায়। এর ফলে বাজারে পণ্যের জোগান বৃদ্ধি পায় এবং মূল্য স্থিতিশীল থাকে।
বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলাফল ও প্রভাব:
আলাউদ্দিন খিলজির এই ব্যবস্থার ফলে:
• পণ্যের দাম ছিল স্থির ও স্বল্প।
• মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
• মজুতদারি, চোরা বাজার, মূল্যবৃদ্ধি – এই সমস্যাগুলো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে।
• সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্য সরবরাহ ও রসদ জোগানে কোন অসুবিধা হয়নি।
• দিল্লি ও তার আশেপাশের অঞ্চলে বাজার ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আসে।
সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা:
এই ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে সুলতানের ব্যক্তিগত নেতৃত্ব ও শক্তিশালী প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর এই ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তদ্ব্যতীত:
• কিছু ব্যবসায়ী ও ধনিকশ্রেণির মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
• বাজারে পণ্যের গুণমান নিয়ন্ত্রণ সবসময় সম্ভব হয়নি।
• দুর্নীতিপরায়ণ দপ্তর ও কিছু নজরদার কর্মকর্তার কারণে শাসনের স্বচ্ছতা অনেক সময় বজায় থাকত না।
উপসংহার:
আলাউদ্দিন খিলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মধ্যযুগীয় ভারতীয় অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তাঁর এই ব্যবস্থা কেবলমাত্র বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করেই থেমে থাকেনি, বরং এটি ছিল একটি বৃহত্তর সমাজসংস্কারের অংশ। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দক্ষতা, সেনাবাহিনীর রসদ জোগান এবং জনগণের জীবনের মান উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হন।
তাঁর এই নীতি আজও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এক অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচিত হয়। কঠোর শাসন, দৃঢ় সিদ্ধান্ত এবং বাস্তবমুখী প্রশাসনিক দক্ষতার মেলবন্ধন যে কিভাবে একটি রাজ্যের অর্থনীতি ও সমাজকে স্থিতিশীল করতে পারে—আলাউদ্দিন খিলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
Unit–2: মুঘলদের উত্থানের প্রেক্ষাপট
*****2) প্রশ্ন. শেরশাহ শুধুমাত্র একজন উদ্ভাবক ছিলেন না। তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল সরকারী প্রশাসন যন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত ও দক্ষ করে তোলা - তুমি কি এই বক্তব্যের সাথে একমত?
ভূমিকা:
ভারতের ইতিহাসে শেরশাহ সূরির নাম এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে। তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ শাসক, দক্ষ সংগঠক, এবং যুগান্তকারী সংস্কারক। তার শাসনকাল যদিও খুব স্বল্পস্থায়ী (১৫৪০-১৫৪৫), তবুও এই স্বল্প সময়ে তিনি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এমনসব পরিবর্তন সাধন করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট আকবর সহ আরও অনেক শাসক অনুসরণ করেছিলেন। এই কারণে ইতিহাসবিদদের অনেকেই মনে করেন যে শেরশাহ কেবল একজন উদ্ভাবক ছিলেন না, বরং তার গভীর উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক কাঠামোকে পুনর্জীবিত করে এক কার্যকর ও জনমুখী সরকার গঠন করা।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব শেরশাহের শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন দিক, তার সংস্কারমূলক পদক্ষেপ, এবং তার প্রশাসনিক দক্ষতার মাধ্যমে এই বক্তব্যটির সপক্ষে যুক্তি খণ্ডন করব।
১. শেরশাহের প্রশাসনিক দক্ষতা ও উদ্দেশ্য:
শেরশাহ একজন কৌশলী শাসক ছিলেন যিনি বুঝেছিলেন যে একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে সুদৃঢ় প্রশাসনিক ব্যবস্থা অপরিহার্য। তিনি কেন্দ্র ও প্রদেশীয় স্তরে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার লক্ষ্য ছিল এমন একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা, যা শুধু শৃঙ্খলা ও শাসনের জন্য নয়, বরং জনগণের কল্যাণ সাধনেও সহায়ক হবে।
তিনি প্রশাসনকে শুধুমাত্র রাজস্ব আদায় বা সামরিক দিক থেকে দেখেননি, বরং এর সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন সামাজিক ন্যায়, জনসুরক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নকে।
২. রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার:
শেরশাহের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও সুপরিচিত কাজ ছিল তার রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার। তিনি ভূমি জরিপের ভিত্তিতে কৃষিজমি শ্রেণিবিন্যাস করেন এবং প্রত্যেক জমির জন্য নির্দিষ্ট কর ধার্য করেন। প্রতি বিঘা জমির উপর ভিত্তি করে কর নির্ধারণ করা হয়, যা কৃষকদের জন্য ছিল সুনির্দিষ্ট ও পূর্বানুমেয়।
তিনটি মূল পদক্ষেপ ছিল:
• ভূমি জরিপ ও পরিমাপ (measurement and survey)
• ফসলভিত্তিক কর নির্ধারণ (crop-based revenue system)
• আগ্রিম কর সংগ্রহ নয়, বরং ফসল কাটার পরে আদায় (post-harvest collection)
এই ব্যবস্থায় দুর্নীতি কমে আসে, মধ্যস্থতাকারীর শোষণ হ্রাস পায় এবং কৃষকরা সরাসরি সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এটি নিশ্চিত করে যে শেরশাহের উদ্দেশ্য কেবল কর আদায় ছিল না, বরং কৃষকদের ওপর শোষণ কমিয়ে কার্যকর শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
৩. মুদ্রানীতি ও অর্থনৈতিক সংস্কার:
শেরশাহের মুদ্রানীতি প্রশাসনিক দক্ষতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি রূপার মুদ্রা "রুপি" চালু করেন, যা পরবর্তীতে সমগ্র ভারতবর্ষে একটি মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। তামা ও সোনার মুদ্রাও প্রচলন করেন। তার এই মুদ্রানীতি ভারসাম্যপূর্ণ ছিল এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে উৎসাহিত করেছিল।
একজন উদ্ভাবকের তুলনায়, একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবেই তিনি মুদ্রানীতিকে এমনভাবে পরিচালনা করেন যাতে দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য সহজতর হয়। এর ফলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে এবং জনগণের ওপর বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
৪. যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সড়ক নির্মাণ:
শেরশাহের শাসনামলে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। তিনি বিখ্যাত "সড়ক-ই-আজম" (Grand Trunk Road) নির্মাণ করেন, যা বাংলার সোনারগাঁও থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই রাস্তায় নির্দিষ্ট দূরত্বে সারাই (সরাইখানা) তৈরি করা হয়, যেখানে যাত্রীদের থাকার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা ছিল।
এছাড়াও প্রতিটি সরাইখানায় ডাকঘর, অশ্বারোহী ডাকপিয়ন, এবং প্রহরী নিযুক্ত থাকতো। এর ফলে কেবল যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নই ঘটেনি, বরং প্রশাসনের নজরদারি, বিচার ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সামরিক কার্যক্রম অনেক বেশি কার্যকর হয়।
৫. বিচারব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা:
শেরশাহ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি বিচারব্যবস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা করেছিলেন। হিন্দুদের জন্য হিন্দু বিচারক ও মুসলিমদের জন্য কাজি নিয়োগ করেন।
তিনি চুরি-ডাকাতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, এবং কোথাও যদি ডাকাতি হতো, সেখানকার স্থানীয় প্রশাসককে দায়ী করা হতো। এটি প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও সততার অনন্য দৃষ্টান্ত।
৬. সামরিক ও কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা:
শেরশাহ তার সামরিক বাহিনীকে সংগঠিত করেন মুঘলদের মতো নয়, বরং তিনি নিজেই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। সৈন্যদের নাম, অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়ার সংখ্যা—সব কিছু রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ রাখা হতো। এটি ছিল মেরিট ভিত্তিক নিয়োগের এক নিদর্শন।
তিনি দাগ এবং হাজিরা পদ্ধতি চালু করেন, যার ফলে সেনা প্রশাসনে দুর্নীতির পরিমাণ কমে যায়। এছাড়া প্রতিটি প্রদেশে শক্তিশালী প্রশাসক নিযুক্ত করেন যারা সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন ছিল।
৭. ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সমাজনীতি:
যদিও তিনি ছিলেন একজন মুসলিম শাসক, কিন্তু শেরশাহ ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বজায় রেখেছিলেন। হিন্দু মন্দির ধ্বংস না করে তিনি হিন্দুদের ওপর কোনও অতিরিক্ত কর আরোপ করেননি। বরং হিন্দু ভূস্বামীদের থেকে রাজস্ব আদায়ে তিনি তাদের সম্মান বজায় রেখে চলেছেন।
এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে শেরশাহ একজন উদ্ভাবক বা কেবল ক্ষমতালোভী শাসক ছিলেন না, বরং সমাজের সকল শ্রেণির মধ্যে ভারসাম্য রেখে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করেছিলেন।
৮. জনগণের কল্যাণমুখী শাসন:
শেরশাহের বিভিন্ন পদক্ষেপ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তার শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল প্রজাদের মঙ্গল। তিনি সরাইখানা, কূপ, সড়ক নির্মাণ, ডাক ব্যবস্থার উন্নয়ন, সুশৃঙ্খল প্রশাসন ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের জীবনে স্বস্তি ও সুরক্ষা এনে দেন।
এইসব পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি একজন সুদূরদর্শী প্রশাসক হিসেবে প্রমাণ রেখেছেন, যিনি তার শাসনকালে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
উপসংহার:
সব দিক বিচার করে বলা যায়, শেরশাহ সূরি নিঃসন্দেহে একজন উদ্ভাবক ছিলেন, কিন্তু তার উদ্ভাবনের পেছনে ছিল গভীর প্রশাসনিক বোধ ও দক্ষতা। তিনি শুধু নতুন কিছু আবিষ্কার করেই থেমে যাননি, বরং সেই আবিষ্কারগুলিকে রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করেছিলেন।
তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ, কার্যকর, জনমুখী এবং স্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গঠন, যার মাধ্যমে রাজ্য পরিচালনা যেমন সহজ হয়, তেমনি জনগণও উপকৃত হয়। এই কারণেই বলা যায়, তিনি কেবল উদ্ভাবক নন, বরং প্রশাসনিক যন্ত্রকে পুনর্জীবিত ও দক্ষ করার এক মহান পরিকল্পক ছিলেন।
অতএব, প্রশ্নে উল্লিখিত বক্তব্যের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত।
Unit–3
*****3) প্রশ্ন. আঞ্চলিক রাজ্য হিসেবে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের উৎপত্তি বা উত্থান সম্পর্কে আলোচনা কর। ৫ /১০
ভূমিকা:
ভারতের ইতিহাসে মধ্যযুগ ও ঔপনিবেশিক যুগের সন্ধিক্ষণে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের প্রেক্ষাপটে যে ক’টি আঞ্চলিক শক্তি আত্মপ্রকাশ করেছিল, হায়দ্রাবাদ ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। ১৮শ শতকে মুঘল শাসনের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়লে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাদেশিক গভর্নররা স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ ভারতে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের জন্ম হয়, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নিজাম-উল-মুলক আসাফ জাহ। হায়দ্রাবাদ শুধু একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক রাজ্য হিসেবেই গড়ে ওঠেনি, বরং পরবর্তী সময়ে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
হায়দ্রাবাদ রাজ্যের উৎপত্তির পটভূমি:
১৭০৭ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এই সময় মুঘল শাসনের অধীন বিভিন্ন সুবেদার ও সামন্ত শাসকরা নিজেদের শাসনাধীন অঞ্চলকে স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে শুরু করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চল ছিল দাক্ষিণাত্য, যার মধ্যে হায়দ্রাবাদ অন্যতম প্রধান অঞ্চল। এখানে মুঘলদের পক্ষ থেকে সুবেদার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন মির কামরুদ্দিন খান, যিনি পরে আসাফ জাহ উপাধি গ্রহণ করে স্বাধীন হায়দ্রাবাদ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
হায়দ্রাবাদ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা:
হায়দ্রাবাদ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মির কামরুদ্দিন খান, যিনি পরবর্তীতে নিজাম-উল-মুলক আসাফ জাহ উপাধি লাভ করেন। তিনি মুঘল দরবারে একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ আমলা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৭২৪ সালে তিনি মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের অনুমতি নিয়ে দাক্ষিণাত্য অঞ্চলের সুবেদার নিযুক্ত হন এবং ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আনুগত্য দূরে সরিয়ে হায়দ্রাবাদকে একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
নিজাম-উল-মুলক এর শাসন ও প্রশাসনিক দক্ষতা:
নিজাম-উল-মুলক অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। তিনি হায়দ্রাবাদ রাজ্যে একটি সুসংগঠিত প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করেন। রাজ্যকে বিভিন্ন জেলায় ভাগ করে প্রতিটি জেলার প্রশাসনের দায়িত্ব নির্দিষ্ট কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেন। তিনি রাজস্ব ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেন এবং কৃষকদের ওপর অনধিক কর আরোপে গুরুত্ব দেন, যাতে রাজ্যের অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকে।
রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ও স্বাধীনতা:
যদিও নিজাম নিজেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুঘল সম্রাটের অধীন শাসক হিসেবে ঘোষণা করতেন, তবে বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ১৭২৪ সালের পর থেকে তিনি কার্যত স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন এবং কেন্দ্রের সঙ্গে শুধু আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখতেন। তাঁর এই কৌশলী অবস্থান হায়দ্রাবাদকে অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির তুলনায় কিছুটা নিরাপদ রেখেছিল।
হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ভূগোল ও জনসংখ্যা:
হায়দ্রাবাদ রাজ্য ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ ভারতের এক বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। এর অন্তর্গত অঞ্চলগুলির মধ্যে বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজ্যের রাজধানী ছিল হায়দ্রাবাদ শহর, যা ঐতিহাসিকভাবে গৌরবময় এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ছিল। এখানে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করত, এবং রাজ্যজুড়ে এক বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।
সামরিক শক্তি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা:
হায়দ্রাবাদ রাজ্য তার সামরিক বাহিনীর জন্য সুপরিচিত ছিল। নিজাম-উল-মুলক একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেন, যার মধ্যে পদাতিক, অশ্বারোহী ও কামানবাহী বাহিনী অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজ্য রক্ষার জন্য বিভিন্ন দুর্গ নির্মাণ করা হয় এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে পরবর্তীকালে সামরিক চুক্তিও করা হয়, যার মাধ্যমে তারা হায়দ্রাবাদকে একটি রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করত।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন:
হায়দ্রাবাদ রাজ্য অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। কৃষি ছিল রাজ্যের মূল ভিত্তি, পাশাপাশি বস্ত্র, হস্তশিল্প, হীরা-মানিক ব্যবসা ও বাণিজ্যের জন্য হায়দ্রাবাদ সুপরিচিত ছিল। গোলকোণ্ডা খনি থেকে প্রাপ্ত হীরা বিশ্ববিখ্যাত ছিল। রাজ্যজুড়ে বাজার, বন্দরে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড অত্যন্ত সচল ছিল।
ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পর্ক:
১৮শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হায়দ্রাবাদ রাজ্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। ফরাসিদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় নিজাম ব্রিটিশদের সহায়তা চেয়েছিলেন এবং এভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হায়দ্রাবাদে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ১৭৯৮ সালে ‘সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স’ স্বাক্ষরের মাধ্যমে হায়দ্রাবাদ ব্রিটিশদের অধীন একটি রক্ষিত রাজ্য (princely state) হয়ে ওঠে।
নিজাম বংশের উত্তরসূরিরা:
আসাফ জাহ I-এর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরিরা হায়দ্রাবাদ রাজ্য শাসন করে গেছেন। প্রত্যেক নিজাম নিজ নিজ সময়ে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। যদিও তাদের অনেকেই ব্রিটিশদের প্রভাবের মধ্যে থাকতেন, তবুও তাঁরা আভ্যন্তরীণ শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রায় স্বাধীনতা ভোগ করতেন।
শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে হায়দ্রাবাদ:
হায়দ্রাবাদ ছিল তৎকালীন ভারতের অন্যতম শিক্ষাবিষয়ক কেন্দ্র। নিজামদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু স্কুল, কলেজ ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। উর্দু, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষার সাহিত্য চর্চা এখানে ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। পাশাপাশি ইসলামী স্থাপত্য, সংগীত, ক্যালিগ্রাফি ও চিত্রকলার ক্ষেত্রেও হায়দ্রাবাদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করত।
১৯৪৭ পরবর্তী অবস্থান ও ভারতের সঙ্গে একীকরণ:
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর অধিকাংশ দেশীয় রাজ্য ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলেও হায়দ্রাবাদ রাজ্যের নিজাম তখনও স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেন। নিজাম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে চাননি, বরং আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন। তবে ১৯৪৮ সালে 'অপারেশন পোলো' নামে ভারতীয় সেনা অভিযান চালিয়ে হায়দ্রাবাদকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে।
উপসংহার:
আঞ্চলিক রাজ্য হিসেবে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের উত্থান এক ঐতিহাসিক গুরুত্ববাহী ঘটনা। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সময় যে ক’টি রাজ্য নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে পেরেছিল, হায়দ্রাবাদ তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। নিজামদের প্রশাসনিক দক্ষতা, সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক কৌশল হায়দ্রাবাদকে দীর্ঘ সময় ধরে দক্ষিণ ভারতের এক শক্তিশালী ও গৌরবময় রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলে। ইতিহাসে এই রাজ্যের স্থান শুধুমাত্র একটি প্রাদেশিক শাসন নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি ও শক্তির কেন্দ্র হিসেবেও গণ্য করা হয়।
Unit–4
*******4) প্রশ্ন. মুঘল যুগের সমাজজীবনের চিত্র সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো। (১০ নম্বর, ২০২৩)
ভূমিকা:
মুঘল সাম্রাজ্য ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রায় আড়াইশো বছরব্যাপী (১৫২৬ খ্রিঃ – ১৮৫৭ খ্রিঃ) ভারত শাসনকালে মুঘল শাসকেরা কেবল প্রশাসনিক ও সামরিক দিক থেকেই নয়, বরং সমাজজীবনের নানা ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই শাসনকাল ছিল ভারতীয় সমাজের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের এক যুগান্তকারী সময়। মুঘল আমলে সমাজজীবনের একটি স্বতন্ত্র রূপ গড়ে ওঠে, যেখানে শ্রেণিভেদ, ধর্মীয় সহাবস্থান, পেশাগত বিভাজন, নারীর অবস্থান, সামাজিক রীতিনীতি প্রভৃতি বিষয়ের বিকাশ ঘটে।
সমাজব্যবস্থার গঠন:
মুঘল যুগের সমাজ একটি শ্রেণিভিত্তিক সমাজ ছিল। এই সমাজ প্রধানত দুটি বৃহৎ শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল—উচ্চবর্গ ও সাধারণ জনগণ।
১. উচ্চবর্গ:
এই শ্রেণির মধ্যে শাসকবর্গ, মনসবদার, জমিদার, আমির, সৈনিক, উচ্চপদস্থ ধর্মীয় নেতা, অভিজাত ব্যবসায়ী ও শিক্ষিত সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরা সাধারণত প্রচুর জমির মালিক ছিল এবং বিভিন্ন রাজস্ব সুবিধা পেত। মুঘল দরবারে উচ্চবর্গীয় মুসলমান ও হিন্দু, উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল। বিশেষ করে আকবরের সময় হিন্দুদের দরবারে স্থান দেওয়ার মাধ্যমে সামাজিক সমন্বয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. সাধারণ জনগণ:
এই শ্রেণিতে কৃষক, কামার, কুমোর, তাঁতী, জেলে, শ্রমিক, নাপিত, মুচি, দিনমজুর ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাধারণ জনগণ মূলত কৃষিকাজ ও হস্তশিল্পের উপর নির্ভরশীল ছিল। এই শ্রেণির জীবনযাত্রা ছিল কষ্টকর। রাজস্বের চাপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ও প্রশাসনিক শোষণের কারণে এদের অবস্থান ছিল দুর্বল।
ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা:
মুঘল সমাজে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। শাসকদের অধিকাংশই মুসলমান হলেও মুঘল আমলে ধর্মীয় সহনশীলতা ও সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়।
১. ইসলাম:
মুঘল শাসকেরা সুন্নি মুসলমান হলেও বিভিন্ন শাসকের মধ্যে ধর্মীয় নীতির পার্থক্য দেখা যায়। যেমন—আকবর ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতিতে বিশ্বাস করতেন এবং ‘দীন-ই-ইলাহি’ প্রবর্তন করে হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থানকে উৎসাহিত করেন। অপরদিকে আওরঙ্গজেব ছিলেন ধর্মীয়ভাবে কট্টর। তিনি শরিয়তি আইন অনুসারে শাসন চালাতে আগ্রহী ছিলেন।
২. হিন্দুধর্ম:
ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হিন্দু ছিল। তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি, উৎসব ও সমাজব্যবস্থা বহাল ছিল। অনেক হিন্দু রাজপুত মুঘল প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন।
৩. অন্যান্য ধর্ম:
শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পার্সিদেরও দেখা যায় এই সমাজে। মুঘল আমলে এই ধর্মগুলিও সীমিতভাবে টিকে ছিল। খ্রিষ্টান মিশনারিরা এই সময় ভারতে আসেন এবং ধর্ম প্রচার করেন।
জাতিভেদ ও সামাজিক বিভাজন:
হিন্দু সমাজে জাতিভেদ প্রথা ছিল ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চারটি মূল বর্ণভিত্তিক বিভাজনের পাশাপাশি অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ও সমাজের নিচের স্তরে অবস্থান করত। মুঘল শাসকেরা যদিও সরাসরি এই জাতিভেদের পরিবর্তন আনেননি, তবে তাদের শাসনকালীন প্রশাসনিক নীতিতে জাতিভেদের প্রভাব আংশিকভাবে খর্ব হয়।
পেশাভিত্তিক সমাজ:
মুঘল সমাজ পেশাভিত্তিক শ্রেণি বিভাজনের দিক থেকে ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ।
• কৃষক শ্রেণি ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং রাজস্ব প্রদানকারী।
• শিল্পী ও কারিগর যেমন তাঁতী, কুমোর, কামার প্রভৃতি শ্রেণি ছিল শহুরে ও গ্রামীণ জীবনের মূল ভিত্তি।
• ব্যবসায়ী সম্প্রদায় মুঘল আমলে দেশীয় ও বিদেশি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
• ধর্মীয় পণ্ডিত ও মৌলভী সমাজে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন এবং শাসকদের কাছেও প্রভাবশালী ছিলেন।
নারীর অবস্থান:
মুঘল সমাজে নারীর অবস্থান ছিল দ্বৈত প্রকৃতির। উচ্চবর্গীয় নারীরা ছিল পর্দানশীন এবং তাদের শিক্ষার সুযোগ সীমিত ছিল, যদিও কোনো কোনো রাণী যেমন—নূরজাহান, জাহানারা বেগম প্রভৃতি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। সাধারণ নারী সমাজে কর্মজীবী নারীর উপস্থিতি ছিল। তাঁরা কৃষিকাজ, তাঁত বোনা, বাসন তৈরি, মাছ ধরা ইত্যাদি কাজে সহায়তা করতেন।
শিক্ষার অবস্থা:
মুঘল আমলে শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মনির্ভর ছিল। মুসলমানদের মধ্যে মাদ্রাসা ও মক্তবে ইসলাম ধর্ম, ফারসি ভাষা ও ধর্মীয় আইন শিক্ষা দেওয়া হতো। হিন্দুদের মধ্যে পাঠশালা ও টোল ছিল প্রচলিত, যেখানে সংস্কৃত, গণিত, ব্যাকরণ প্রভৃতি বিষয় পড়ানো হতো। আকবরের সময় শিক্ষার উন্নয়নে কিছু সংস্কার আনা হয়। তিনি ধর্মীয় বিভেদ না রেখে জ্ঞানচর্চাকে উৎসাহিত করেন।
পোশাক ও খাদ্যাভ্যাস:
মুঘল যুগে উচ্চবর্গীয়দের পোশাকে ছিল রাজকীয়তা। তাঁরা রেশম, মসলিন, জরির কাজ করা জামা, পাগড়ি, অলংকার পরিধান করতেন। সাধারণ জনগণ তুলনায় সাধারণ পোশাক পরতেন।
খাদ্যাভ্যাসেও ভিন্নতা ছিল। মুঘল দরবারে বিরিয়ানি, কোরমা, কাবাব, পোলাও, ফিরনি, শিরকুরমা প্রভৃতি রাজকীয় খাবার প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষ চাল, ডাল, শাকসবজি ও মাছ-মাংস আহার করত।
স্থাপত্য ও সংস্কৃতি:
মুঘল সমাজে শিল্প-সংস্কৃতির উজ্জ্বল বিকাশ ঘটে। স্থাপত্যশৈলী যেমন তাজমহল, লালকেল্লা, হুমায়ুনের সমাধি ইত্যাদি শুধু ধর্মীয় ভাবনায় নয়, সামাজিক ঐতিহ্যের প্রতিফলনও ঘটায়। এই যুগে ফারসি সাহিত্য, চিত্রকলাও সমানভাবে সমৃদ্ধ হয়।
সামাজিক উৎসব ও বিনোদন:
মুঘল যুগে সমাজজীবনে বিভিন্ন ধর্মীয় ও পার্বণ উৎসব পালন করা হতো। মুসলমানদের ঈদ, মহরম, হিন্দুদের দোল, দুর্গাপূজা, দীপাবলি—সমানভাবে পালিত হতো। রাজদরবারে সংগীত, নৃত্য, কবিতা পাঠ, কুস্তি, দমন-দাও, শিকার প্রভৃতি ছিল বিনোদনের অংশ।
আইন ও বিচারব্যবস্থা:
মুঘল সমাজে বিচারব্যবস্থা ছিল প্রধানত শরিয়তি আইনের উপর নির্ভরশীল। তবে হিন্দুদের জন্য ধর্মশাস্ত্র অনুসারে বিচার হতো। প্রতি শহরে কাজী ও বিচারক নিযুক্ত থাকতেন। দারোগারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতেন।
সামাজিক সমস্যা:
এই সমাজে একাধিক সামাজিক সমস্যা বিরাজমান ছিল—
• নারীদের অশিক্ষা ও বাল্যবিবাহ।
• জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা।
• দরিদ্র শ্রেণির উপর রাজস্ব শোষণ।
• উঁচু ও নিচু শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য।
উপসংহার:
মুঘল যুগের সমাজজীবন ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ, জটিল ও বহুস্তরবিশিষ্ট। এই সমাজে ধর্মীয় সহাবস্থান, সংস্কৃতির বিকাশ, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নয়ন যেমন ছিল, তেমনি সামাজিক বিভাজন, বৈষম্য ও নির্দিষ্ট শ্রেণির আধিপত্যও বিদ্যমান ছিল। আকবরের মত শাসক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করলেও, আওরঙ্গজেবের শাসনে ধর্মীয় সংকীর্ণতা ফিরে আসে। তবুও, মুঘল যুগের সমাজজীবন ভারতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা পরবর্তী যুগে ভারতীয় সমাজগঠনের ভিত রচনা করে।