Kalyani University Suggestion
Kalyani University B.A 5th Semester History Minor Nep Suggestions 2026
History of Modern India
Kalyani University B.A 5th Semester History Minor Nep ছোট প্রশ্ন, বড়ো প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন PDF টি পেতে.. তুমি 150 টাকা পেমেন্ট কর। পেমেন্টের পর এক সেকেন্ডের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সাজেশনটি পাবে। ধন্যবাদ। টাকা টি পেমেন্ট করার জন্য নিচে PAY বাটনে ক্লিক কর।
তুমি চাইলে সরাসরি PhonePe-এর মাধ্যমে 150 টাকা পেমেন্ট করে সাজেশন সংগ্রহ করতে পার। PhonePe নম্বর: 6295668424 (পেমেন্টের পর স্ক্রিনশট হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালে PDF COPY পাঠিয়ে দেব।)
My Phone Number- 6295668424
• এই সাজেশনের বড়ো প্রশ্ন সংখ্যা 29 টি।
ছোট প্রশ্ন প্রশ্নের উত্তর সহ কমপ্লিট সাজেশন পাবেন।
• নিরক্ষরেখে বলতে পারি এই সাজেশনেরর বাইরে কোন প্রশ্ন উত্তর আসবে না।
• ১০০% তোমরা কমন পাবে।
• এই সাজেশনের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সিলেবাস অনুযায়ী এবং ইউনিট
অনুযায়ী সাজানো রয়েছে ।
• তোমরা চাইলে খুব সহজে BUY করতে পারো।
• THANK YOU.
এখানে অল্প কিছু প্রশ্নোত্তর আপলোড করা হয়েছে যদি তোমার মনে হয় সাজেশনটি BUY করতে পারো ।
History of Modern India
(সিলেবাস – ২০২৫)
Unit – 1: Expansion and consolidation of British Rule in India, land revenue settlements and their impact, colonial state and development of its administration, orientalism and utilitarianism.
বাংলা অনুবাদ: ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সম্প্রসারণ ও একত্রীকরণ, ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্ত এবং তাদের প্রভাব, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ও এর প্রশাসনের বিকাশ, প্রাচ্যবাদ ও উপযোগবাদ।
Unit – 2: Exploitation and resistance, de-peasantization and de-industrialization, drain of wealth, famines in India, resistance from the tribes and peasants till the Revolt of 1857, analyzing the revolt and its consequences, colonial policy of further exploitation through railways and industrial network.
বাংলা অনুবাদ: শোষণ ও প্রতিরোধ, কৃষকের বাণিজ্যিকীকরণ ও অবশিল্পায়ন, সম্পদের বহির্গমন, ভারতে দুর্ভিক্ষ, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ পর্যন্ত উপজাতি ও কৃষকের প্রতিরোধ, বিদ্রোহ ও তার পরিণতি বিশ্লেষণ, রেলওয়ে ও শিল্প নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অধিক শোষণের ঔপনিবেশিক নীতি।
Unit – 3: The cultural revolution of the nineteenth century, critique of the Young Bengal Movement, Bengal Renaissance, social and religious reforms, colonization of education, the women’s question.
বাংলা অনুবাদ: ঊনবিংশ শতাব্দীর সাংস্কৃতিক বিপ্লব, ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সমালোচনা, বাংলার নবজাগরণ, সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার, শিক্ষার উপনিবেশীকরণ, নারী প্রশ্ন।
Unit – 4: Interpreting Indian nationalism, Swadeshi Movement and different phases of the nationalist struggle, role of Gandhi, Tagore, Subhas Bose, Nehru and Jinnah, workers’ and peasants’ movements, religious polarisation of national politics, partition and independence (1947).
বাংলা অনুবাদ: ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা, স্বদেশী আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহেরু ও মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর ভূমিকা, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন, জাতীয় রাজনীতির ধর্মীয় মেরুকরণ, দেশভাগ ও স্বাধীনতা (১৯৪৭)।
সম্পূর্ণ সাজেশন টি ইউটিউবে দেখানো হয়েছে তুমি দেখে আসতে পারো।
Unit – 1: ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সম্প্রসারণ ও একত্রীকরণ, ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্ত এবং তাদের প্রভাব, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ও এর প্রশাসনের বিকাশ, প্রাচ্যবাদ ও উপযোগবাদ।
*****1) প্রশ্ন. ঔপনিবেশিক বাংলার কৃষকদের অর্থনৈতিক জীবনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব আলোচনা কর। (৫) [২০২০]
ভূমিকা:
ভারতের ইতিহাসে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ শাসক লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক চালু করা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent Settlement) ছিল এক যুগান্তকারী ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা। বাংলার জমিদারি কাঠামোতে এ ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে গভীর ছাপ রেখে যায়। এই বন্দোবস্তের মূল লক্ষ্য ছিল— ইংরেজ সরকারকে স্থায়ী রাজস্ব প্রদান এবং জমিদার শ্রেণিকে প্রশাসনিকভাবে নিজেদের অনুগত করা। কিন্তু এর প্রকৃত পরিণতি দেখা গিয়েছিল বাংলার কৃষকদের জীবনে, যারা উৎপাদনের প্রধান শক্তি হওয়া সত্ত্বেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অর্থনৈতিকভাবে তারা দারিদ্র্যের গভীরে তলিয়ে যায়, শোষণ, ঋণগ্রস্ততা ও সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রকৃতি
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুযায়ী—
1. জমিদাররা তাদের অধীন ভূমির উপর চিরস্থায়ী মালিকানা লাভ করে।
2. জমিদারদের প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব ব্রিটিশ সরকারের কাছে জমা দিতে হতো।
3. যদি কোনো জমিদার নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ হত, তবে তার জমিদারি নিলামে বিক্রি করা হত।
4. কৃষকদের কোনো আইনি সুরক্ষা বা অধিকার প্রদান করা হয়নি। তারা জমিদারের অধীনস্থ ‘প্রজা’ হিসেবে থেকে যায়।
এ ব্যবস্থার ফলে জমিদাররা সরকারের দৃষ্টিতে ভূমির স্থায়ী মালিক হলেও প্রকৃত উৎপাদনকারী কৃষকরা বঞ্চিত হয়।
বাংলার কৃষকদের অর্থনৈতিক জীবনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব:
১. কৃষকদের জমির অধিকারহীনতা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কৃষকরা ভূমির মালিক না থেকে জমিদারের প্রজা হয়ে ওঠে। তাদের কোনো স্থায়ী স্বত্ব ছিল না। জমিদার চাইলে তাদের উচ্ছেদ করতে পারত। ফলে কৃষকরা জমিতে অনিরাপদ জীবনযাপন করতে থাকে।
২. বাড়তি খাজনা ও শোষণ: রাজস্বের স্থায়িত্ব সত্ত্বেও জমিদাররা কৃষকদের থেকে সর্বোচ্চ ভাড়া আদায় করতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে খাজনা ছিল অত্যধিক মাত্রায়। কৃষকরা যদি সময়মতো খাজনা দিতে না পারত, তবে তারা ভূমি থেকে উৎখাত হত। এভাবে কৃষকরা চরম শোষণের শিকার হয়।
৩. মধ্যস্বত্বভোগীর উত্থান: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ‘মধ্যস্বত্বভোগী’ শ্রেণির জন্ম হয়। জমিদাররা সরাসরি খাজনা আদায় না করে মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে তা আদায় করতে শুরু করে। এরা কৃষকদের উপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করত, ফলে কৃষকের উপর দ্বিগুণ শোষণ চাপতে থাকে।
৪. কৃষকদের ঋণগ্রস্ততা: অতিরিক্ত খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে কৃষকদের অনেক সময় মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হত। ফলে ঋণ শোধ করতে গিয়ে তারা আরও দারিদ্র্যের গভীরে তলিয়ে যেত। অনেকে ঋণ শোধ করতে গিয়ে জমি হারিয়ে ভূমিহীন শ্রমিকে পরিণত হয়।
৫. কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও উন্নতির অভাব: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কৃষকদের জীবনে কৃষি উন্নয়নের কোনো সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। জমিদাররা কৃষিক্ষেত্রে কোনো বিনিয়োগ করেনি। কৃষকদেরও কোনো সুরক্ষা বা উৎসাহ দেওয়া হয়নি। ফলে কৃষিক্ষেত্রে অবনতির ধারা শুরু হয়।
৬. দুর্ভিক্ষে কৃষকের ভোগান্তি: ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে মহাদুর্ভিক্ষে বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর পরে একই পরিস্থিতি বজায় থাকে। দুর্ভিক্ষের সময় জমিদাররা খাজনা আদায় বন্ধ করেনি। ফলে কৃষকদের দুর্দশা বহুগুণ বেড়ে যায়।
৭. নগদ অর্থ অর্থনীতির বিস্তার: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে খাজনা নগদ অর্থে আদায় করা শুরু হয়। কৃষকরা অনেক সময় শস্য বিক্রি করে নগদ অর্থ সংগ্রহ করত। এতে বাজারকেন্দ্রিক কৃষির প্রসার ঘটে, তবে কৃষকরা এতে লাভবান হয়নি। বরং বাজারমূল্যের ওঠানামায় তারা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৮. দারিদ্র্য ও অনাহার: অতিরিক্ত খাজনা, ঋণ, মহাজনি শোষণ ও জমিদারি দমননীতি কৃষকদের অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে দেয়। তারা দিনে দিনে চরম দারিদ্র্যের শিকার হয়। অনেক সময় তাদের খাদ্যের অভাব দেখা দেয়, অনাহারে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
৯. বিদ্রোহ ও কৃষক আন্দোলন: কৃষকদের উপর এই চরম শোষণের ফলে বাংলায় বিভিন্ন সময়ে বিদ্রোহ ও আন্দোলন দেখা দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— চুয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৯–১৮০৫), ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯–৬০)। এসব বিদ্রোহে কৃষকেরা জমিদার ও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল।
১০. কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকদের কাছে জমি ছিল অনিরাপদ। ফলে তারা জমির প্রতি আন্তরিকতা বা বিনিয়োগ দেখায়নি। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ করা হয়নি। ফলস্বরূপ উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় এবং বাংলার অর্থনীতি পিছিয়ে পড়ে।
সমকালীন ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের তাৎক্ষণিক প্রভাবে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে চরম দুর্দশাগ্রস্ত হয়। আর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে বাংলায় জমিদারি প্রথা আরও দৃঢ় হয়। এই ব্যবস্থার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে স্থায়ী বৈষম্য তৈরি হয় এবং কৃষক সমাজ শোষিত শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত হয়।
সমালোচনা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে ইতিহাসবিদদের মতভেদ থাকলেও অধিকাংশের মতে এটি বাংলার কৃষকদের জন্য অভিশাপস্বরূপ। কৃষকদের কোনো অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি। জমিদাররা কৃষি উন্নয়নে কোনো ভূমিকা নেয়নি। ঋণ, মহাজনি শোষণ, দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্য কৃষক সমাজকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। অন্যদিকে ইংরেজ সরকার ও জমিদার শ্রেণি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হলেও, কৃষকেরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসের পথে এগিয়েছিল।
উপসংহার: সর্বোপরি বলা যায়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার কৃষকদের জন্য এক কালো অধ্যায়। উৎপাদনকারী প্রধান শ্রেণি হয়েও তারা জমির মালিকানা হারায়, শোষণ ও দারিদ্র্যের শিকার হয়। এর ফলে বাংলার গ্রামীণ সমাজে এক দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক সংকট ও বৈষম্যের জন্ম হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের এই নীতি ব্রিটিশ স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হলেও, বাংলার কৃষকসমাজকে করেছে নিঃস্ব, দুর্বল এবং বিদ্রোহমুখর।
Unit – 2: শোষণ ও প্রতিরোধ, কৃষকের বাণিজ্যিকীকরণ ও অবশিল্পায়ন, সম্পদের বহির্গমন, ভারতে দুর্ভিক্ষ, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ পর্যন্ত উপজাতি ও কৃষকের প্রতিরোধ, বিদ্রোহ ও তার পরিণতি বিশ্লেষণ, রেলওয়ে ও শিল্প নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অধিক শোষণের ঔপনিবেশিক নীতি।
*****2) প্রশ্ন. ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের কারণগুলি ব্যাখ্যা কর। [৫/১০]
ভূমিকা: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে বাংলা, বিশেষত প্ল্যাসির যুদ্ধের পর ভারতের রাজনীতিতে ও অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার শুরু করে। এর শাসনকাল দেশের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করেছিল, বিশেষ করে শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। ভারতীয় শিল্প, যা শতাব্দী ধরে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় ছিল, সেই সময়ে ক্রমশ ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যায়। দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের পেছনে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নানা কারণ কাজ করেছিল। এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে সেই কারণগুলি আলোচনা করব।
১. কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিবর্তন এবং নগর শিল্পের ক্ষয়: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের আগে ভারতের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক হলেও নগরায়ণ ও শিল্পেও সমৃদ্ধ ছিল। বাংলার হস্তশিল্প, বিশেষ করে কাপড় বোনা (যেমন জামদানি), তামার ও মেটাল শিল্প, জুতা-চামড়া শিল্প এবং অন্যান্য হস্তশিল্প বাজারে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। কিন্তু কোম্পানির শাসনামলে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে নগর শিল্পের থেকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তারা চাষবাস থেকে সরাসরি কর আদায় করে, ফলে কৃষক ও চাষীরা নগর শিল্পের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ হারায়।
২. ব্রিটিশ নীতি অনুযায়ী রপ্তানি ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের কাঁচামাল রপ্তানিতে উৎসাহ দেয় এবং শেষ পর্যায়ের পণ্য আমদানি করতে বাধ্য করে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় হস্তশিল্পের কাপড় বিদেশে রপ্তানি হতো, কিন্তু ব্রিটিশ কাপড়ের জন্য দেশীয় বাজারে বাধা সৃষ্টি করা হয়। কোম্পানি ভারতীয় হস্তশিল্পের চাহিদা হ্রাস করার জন্য ভীতি মূলক কর আরোপ ও অন্যান্য বিধিনিষেধ প্রয়োগ করেছিল। ফলে দেশীয় শিল্পের উৎপাদন ক্রমশ কমতে থাকে।
৩. সস্তা ব্রিটিশ পণ্যের প্রবেশ: ১৮শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিল্প বিপ্লবের পর ব্রিটেনে যান্ত্রিক উৎপাদন শুরু হয়। ব্রিটিশরা সস্তা যান্ত্রিক পণ্য ভারতীয় বাজারে ঢুকিয়ে দেয়। দেশীয় কারিগরদের হাতে তৈরি পণ্যের চেয়ে যান্ত্রিকভাবে তৈরি ব্রিটিশ পণ্য অনেক সস্তা হওয়ায়, স্থানীয় শিল্পের পণ্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। এর ফলে ভারতীয় কারিগরদের আয় হ্রাস পায় এবং অনেক শিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
৪. কর ও অর্থনৈতিক শোষণ: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের কর এবং শুল্ক আরোপ করেছিল। এটি যেমন চাষী ও ব্যবসায়ীদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল, তেমনি কারিগর ও শিল্পপতিদের ওপরও প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন শিল্প পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রির উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা হয়েছিল। ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়, বাজারে পণ্যের মূল্য বাড়ে এবং চাহিদা হ্রাস পায়। অর্থনৈতিক শোষণের এই প্রক্রিয়াই ধীরে ধীরে দেশীয় শিল্পকে নিপীড়িত করে।
৫. জমির মালিকানা ও ভূমি সংস্কার: ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদারি ব্যবস্থা (যেমন Permanent Settlement 1793) চালু হয়। এর ফলে চাষীরা নির্দিষ্ট কর দিতে বাধ্য হয়, যা নগর শিল্পে বিনিয়োগ করতে পারত না। চাষীরা মূলত বাঁচার জন্য চাষ করতে বাধ্য হয় এবং শিল্পায়নের দিকে মনোযোগ দিতে পারেনি। এছাড়া, জমিদার ও নবাবরা অনেক সময় শিল্পের স্থাপনা ধ্বংস বা দখল করত।
৬. দেশীয় শিল্পের সংগঠন ও সংরক্ষণের অভাব: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রের সাহায্য বন্ধ করে দেয়। প্রথাগত কারিগর গোষ্ঠী বা ‘কাস্তা’ যা শিল্পকে চালিত করত, তারা ব্রিটিশ শাসনের কারণে কার্যত বিলীন হয়ে যায়। কোনো সরকারী বা সামাজিক সমর্থন ছাড়া স্থানীয় শিল্পের টিকে থাকা সম্ভব হয় না।
৭. শ্রম ও কারিগরদের উপর প্রভাব: দেশীয় কারিগররা বহু শতাব্দী ধরে চরম দক্ষতাসম্পন্ন ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ নীতি ও বিদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা তাদের জীবিকা হ্রাস করে। অনেক কারিগর গ্রামত্যাগ করতে বাধ্য হয়, শহর ও শিল্প কেন্দ্রগুলোতে কাজ হারায়। এই শ্রম সংকট ও দক্ষ কারিগরের অভাব দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৮. প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও বিপর্যয়: ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের কারণে যান্ত্রিক উৎপাদন প্রচলিত হয়, যেখানে কম খরচে বেশি পণ্য উৎপাদন সম্ভব। ভারতীয় কারিগররা প্রচলিত হাতের কাজের উপর নির্ভরশীল থাকায় এই প্রতিযোগিতা সহ্য করতে পারে না। প্রযুক্তিগত পার্থক্যও দেশীয় শিল্পের ক্রমশ ধ্বংসের একটি বড় কারণ ছিল।
৯. রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধ: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে প্রায়শই যুদ্ধে অর্থ ও সম্পদ ক্ষয় হতো। স্থানীয় রাজা ও নবাবদের মধ্যে সংঘাত, বিদ্রোহ ও Company-র দমন নীতি শিল্পের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেনি। শিল্পের জন্য নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশ প্রয়োজন, যা এই সময়ে ছিল না।
১০. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন: ব্রিটিশ শাসন দেশের সামাজিক কাঠামোকে প্রভাবিত করেছিল। শিক্ষার ধরন, জীবনযাত্রা ও সামাজিক মানদণ্ডে পরিবর্তন আসে। এটি শিল্পের রীতিনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে কারিগরি ও শিল্পকর্মের প্রতি আগ্রহ হ্রাস পায়।
উপসংহার: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে দেশীয় শিল্পের অবক্ষয় একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া ছিল। এটি শুধু এক বা দুটি কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক শোষণ, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা, প্রযুক্তিগত বৈষম্য, সামাজিক পরিবর্তন এবং স্থানীয় শিল্প সংস্থার অভাবের কারণে ঘটে। স্থানীয় কারিগর ও শ্রমিকরা টিকে থাকতে না পারায়, প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভারতীয় শিল্প ক্রমশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন এই সময়ে স্থায়ীভাবে প্রভাবিত হয়। ব্রিটিশ নীতি, বিশেষত কাঁচামাল রপ্তানি, বিদেশি পণ্যের প্রবেশ, কর ব্যবস্থা ও জমিদারি সংস্কারের কারণে দেশীয় শিল্পের অবক্ষয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই অবক্ষয় ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছিল।
Unit – 3: ঊনবিংশ শতাব্দীর সাংস্কৃতিক বিপ্লব, ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সমালোচনা, বাংলার নবজাগরণ, সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার, শিক্ষার উপনিবেশীকরণ, নারী প্রশ্ন।
*****3) প্রশ্ন. বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন ঐতিহ্যসম্পন্ন আধুনিকতাবাদী — ব্যাখ্যা কর। (১০)
ভূমিকা: ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কারের ইতিহাসে যে কয়েকজন মহামানবের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়, তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অন্যতম। তাঁকে বলা হয় “ঐতিহ্যসম্পন্ন আধুনিকতাবাদী” — কারণ তিনি একদিকে যেমন ভারতীয় সমাজের প্রাচীন নৈতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছিলেন, তেমনি অপরদিকে পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির আদর্শ গ্রহণ করে সমাজ সংস্কারের প্রয়াস নিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন একাধারে সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, মানবপ্রেমিক ও নারীশিক্ষার একনিষ্ঠ প্রবক্তা। তাঁর জীবন ও কর্ম উনিশ শতকের নবজাগরণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ঐতিহ্য ও আধুনিকতার যুগল সমন্বয়: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি একদিকে প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রজ্ঞানের মূলে দাঁড়িয়ে ছিলেন, অপরদিকে পাশ্চাত্য আধুনিকতার যুক্তিবাদী আলোয় সমাজকে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নকালে প্রাচীন সাহিত্যের গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সেই জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোয়। এই দুই ধারার মধ্যে তিনি যে সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, সেটিই তাঁকে "ঐতিহ্যসম্পন্ন আধুনিকতাবাদী" করে তুলেছে। ঐতিহ্যের ভিত্তিতে তিনি কখনো সমাজ সংস্কার করতে গিয়ে ভারতীয় মূল্যবোধকে অস্বীকার করেননি। বরং, তিনি প্রমাণ করেছেন যে প্রাচীন শাস্ত্রেও মানবিকতা, ন্যায় ও সমতার বাণী নিহিত আছে।
সমাজসংস্কারে বিদ্যাসাগরের অবদান: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারমূলক কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল বিধবা-বিবাহ প্রবর্তন, বাল্যবিবাহ রোধ এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা। ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে নারী ছিল সমাজের অবহেলিত ও অবদমিত শ্রেণি। বিধবাদের উপর সমাজের নির্মমতা ছিল অকল্পনীয়। এমন এক সময় বিদ্যাসাগর একা লড়াই শুরু করেছিলেন সমাজের এই অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে।
১. বিধবা-বিবাহ আন্দোলন: বিদ্যাসাগর প্রমাণ করেছিলেন যে হিন্দু শাস্ত্রে কোথাও বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ নয়। তিনি ‘বিধবাবিবাহ প্রচার পুস্তিকা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করে শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সমাজের কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করেন। ১৮৫৬ সালে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার ফলে ‘হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন’ (Act XV of 1856) পাশ হয়। এটি ছিল ভারতের সামাজিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। যদিও সমাজের একাংশ তাঁর এই উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু তিনি তাঁর লক্ষ্য থেকে এক চুলও সরে যাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন— “মানুষের কল্যাণই ধর্মের আসল লক্ষ্য”।
২. বাল্যবিবাহের বিরোধিতা: সমাজে অতি অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। এর ফলে অনেক মেয়েই অল্প বয়সে বিধবা হয়ে সমাজচ্যুত হতো। বিদ্যাসাগর দৃঢ়ভাবে এই কুসংস্কারের বিরোধিতা করেন। তিনি যুক্তি ও মানবিকতার মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন— বাল্যবিবাহ শুধুমাত্র সামাজিক অগ্রগতির পথে বাধা নয়, এটি মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন।
৩. কন্যাশিক্ষার প্রসার: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন সমাজের অন্য যে কারও আগে। তিনি বিশ্বাস করতেন, “নারীশিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি সম্ভব নয়।” ১৮৫০-এর দশকে তিনি কলকাতা ও মেদিনীপুর অঞ্চলে বহু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময়ে যখন নারীদের বিদ্যালয়ে পাঠানো সমাজের চোখে অসম্মানজনক মনে করা হতো, বিদ্যাসাগর নিজের হাতে মেয়েদের ভর্তি করাতে যেতেন এবং অভিভাবকদের বোঝাতেন। নারীদের জন্য পাঠ্যপুস্তকও তিনি নিজে রচনা করেন— যেমন ‘বর্ণপরিচয়’, যা আজও বাংলা শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত।
১. শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার গঠন ও পাঠ্যক্রম সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি বাংলা ভাষাকে সাধারণ মানুষের জন্য সহজ ও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন। তাঁর রচিত ‘বর্ণপরিচয়’, ‘বোধোদয়’, ‘কথামালা’, ‘আখ্যানমঞ্জরী’ প্রভৃতি গ্রন্থ বাংলা শিক্ষার ইতিহাসে অমর। তিনি বিশ্বাস করতেন— শিক্ষা হতে হবে এমন, যা মানুষকে যুক্তিবাদী ও বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন করে তোলে। তাই তিনি শিক্ষাকে কুসংস্কারমুক্ত, বিজ্ঞানসম্মত ও মানবিক করতে চেয়েছিলেন।
২. বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার: তিনি সরকারি শিক্ষা দপ্তরে কর্মরত অবস্থায় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে শতাধিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রচেষ্টাতেই ১৮৫৪ সালের উডস ডিসপ্যাচ (Wood’s Despatch) কার্যকরভাবে বাংলায় প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার আলো সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছাতে হবে— গ্রামীণ ও দরিদ্র জনগণের মধ্যেও। তাঁর এই প্রচেষ্টার ফলে বাংলায় শিক্ষার হার দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং সমাজে নবজাগরণের বীজ রোপিত হয়।
৩. নারীশিক্ষায় বিদ্যাসাগরের প্রধান অবদান: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে ছিলেন এক প্রকৃত পথপ্রদর্শক। ১৮৫৫ সালে তিনি বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য বিশেষ তহবিল সংগ্রহ করেন। তিনি নিজে ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করতেন। তাঁর মতে, “নারী ও পুরুষ উভয়েই মানবজীবনের দুটি চাকা; এক চাকা অচল থাকলে গাড়ি চলবে না।” তাঁর উদ্যোগে কলকাতা, হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর ইত্যাদি জেলায় বহু কন্যাশিক্ষালয় স্থাপিত হয়। তিনি কেবল শিক্ষাদানই করেননি, বরং শিক্ষার সামাজিক স্বীকৃতির জন্যও লড়াই করেছেন। নারীশিক্ষার এই আন্দোলন পরবর্তী সময়ে ভারতের নারী জাগরণের এক ভিত্তি স্থাপন করে।
৪. মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: বিদ্যাসাগরের সমগ্র কর্মজীবনের মূলে ছিল মানবপ্রেম ও সহানুভূতি। তিনি কেবল সমাজসংস্কারক নন, ছিলেন দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। তিনি ব্যক্তিগত অর্থ ব্যয় করে দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার সুযোগ দিয়েছিলেন। তাঁর মানবিকতা এতটাই গভীর ছিল যে, সমাজের শত্রুর প্রতিও তিনি সদয় ছিলেন। এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে অন্যান্য সংস্কারকদের থেকে পৃথক করে তুলেছে।
৫. ঐতিহ্যসম্পন্ন আধুনিকতাবাদী হিসেবে মূল্যায়ন: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি ঐতিহ্যের ভেতর থেকে আধুনিকতার বীজ সন্ধান করেছিলেন। তিনি হিন্দু শাস্ত্রের ভেতর থেকে মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে যুক্তি খুঁজে পেয়েছিলেন, আবার পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ গ্রহণ করে সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর চিন্তায় ছিল না অন্ধ অনুকরণ, বরং ছিল যুক্তির প্রয়োগ ও ন্যায়ের সন্ধান। এই কারণেই তাঁকে বলা হয় ঐতিহ্যসম্পন্ন আধুনিকতাবাদী। তিনি যেমন প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তেমনি আধুনিক যুগের প্রগতিশীল চিন্তাধারার এক প্রভাবশালী প্রতিনিধি।
৬. উপসংহার: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবন এক বিরল উদাহরণ— যেখানে ঐতিহ্য, আধুনিকতা, মানবতা ও শিক্ষা একসূত্রে গাঁথা। তিনি দেখিয়েছেন, সমাজ পরিবর্তনের জন্য বিদ্রোহ নয়, যুক্তি ও মানবিকতা প্রয়োজন। নারীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ, ভাষা ও শিক্ষা সংস্কারে তাঁর অবদান আজও বাঙালি জাতির গর্ব। তাঁর আদর্শ আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, কারণ আজও সমাজে কুসংস্কার, বৈষম্য ও অবিচার বিরাজমান। সত্যিই, বিদ্যাসাগর ছিলেন একাধারে প্রাচ্যের ঐতিহ্যের ধারক ও পাশ্চাত্যের আধুনিকতার প্রবর্তক— এক ঐতিহ্যসম্পন্ন আধুনিকতাবাদী যিনি তাঁর যুগকে ছাপিয়ে আজও আলোকবর্তিকা হয়ে আছেন।
Unit – 4: ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা, স্বদেশী আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহেরু ও মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর ভূমিকা, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন, জাতীয় রাজনীতির ধর্মীয় মেরুকরণ, দেশভাগ ও স্বাধীনতা (১৯৪৭)।
*****4) প্রশ্ন. ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর ভূমিকা ব্যাখ্যা করো। (১০)
Ans: ১৯৪২ সালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ‘ভারত ছাড়ো’ (Quit India) আন্দোলন। ৮ই আগস্ট ১৯৪২ তারিখে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ঘোষণা করেছিল, যে ভারতের জনগণকে ব্রিটিশ শাসকের প্রতি অবাধ্য হতে হবে এবং স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই আন্দোলন শুধুমাত্র রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্য নয়, বরং জাতীয় চেতনা, সামাজিক সাম্য ও গণসংহতির উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে ভারতের বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১. ছাত্র সমাজের ভূমিকা: ছাত্র সমাজ ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় অংশ ছিল। শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কার্যক্রমে অংশ নিত। কলেজ ও স্কুলের ছাত্ররা গণহারে সমাবেশে অংশগ্রহণ করত, প্রচারপত্র বিতরণ করত এবং রাজনৈতিক স্লোগান দিয়ে আন্দোলনের পক্ষে প্রচারণা চালাত। বিশেষ করে মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারের শহরগুলোতে শিক্ষার্থীরা পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে নেমেছিল। ছাত্র সমাজের এ ধরনের উদ্যোগ ব্রিটিশ প্রশাসনকে আতঙ্কিত করেছিল এবং আন্দোলনের তরুণ শক্তিকে দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করেছিল।
২. শ্রমিক শ্রেণীর অবদান: শহুরে শিল্পাঞ্চল ও কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা আন্দোলনের অন্যতম শক্তিশালী ভর ছিলেন। কলকাতা, মুম্বাই, বোম্বে এবং চণ্ডীগড়ের শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকরা ধর্মঘট, হরতাল ও বিক্ষোভের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নিজেরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। শ্রমিকদের এই অংশগ্রহণ শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই পূরণ করেনি, বরং সামাজিক বৈষম্য ও কর্মজীবনের দুর্দশার প্রতিবাদ হিসেবেও কার্যকর হয়েছিল। তাদের সক্রিয়তা আন্দোলনের ভৌগোলিক বিস্তৃতিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
৩. কৃষক সমাজের ভূমিকা: ভারতের গ্রামীণ জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ কৃষক। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে তারা নিরব ভূমিকা পালন করেনি। বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ও মধ্যপ্রদেশের গ্রামে গ্রামীণ জনগণ জমিদার ও কর সংগ্রহকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। বিশেষ করে চাষিরা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হরতাল ও জমির অধিকার সংক্রান্ত বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল। কৃষকদের এই অংশগ্রহণ আন্দোলনের জনসংখ্যাগত ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করেছে এবং গ্রামীণ অঞ্চলের রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করেছে।
৪. নারী সমাজের অবদান: নারী সমাজও ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে আবির্ভূত হয়। মহিলারা সমাবেশে অংশগ্রহণ করতেন, আন্দোলনের পক্ষে প্রচারণা চালাতেন এবং কখনো কখনো গোপন বার্তা ও অস্ত্র পরিবহনের কাজেও যুক্ত হতেন। ভুবনেশ্বর, কলকাতা, নাগপুর এবং লখনউসহ বিভিন্ন শহরে মহিলারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নামেন। এছাড়া, মহিলারা গ্রামীণ আন্দোলনে বিদ্যালয় ও গ্রামীণ সমিতির মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করেছিলেন। এভাবে নারীদের অংশগ্রহণ আন্দোলনের ধারা ও শক্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
৫. ব্যবসায়ী ও বণিক শ্রেণীর অবদান: ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শহুরে ব্যবসায়ী এবং বণিক সমাজও সরাসরি বা পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছিল। ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশ পণ্যের বর্জন, হরতাল এবং ধন সংগ্রহের মাধ্যমে আন্দোলনের তহবিল সংগ্রহ করতেন। মুম্বাই, কলকাতা ও চেন্নাইয়ের বণিক সমাজ ‘স্বদেশী’ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছিল। এর ফলে আন্দোলনের কার্যক্রম স্থায়ী ও ব্যাপকভাবে পরিচালিত হতে সক্ষম হয়।
৬. সাংবাদিকতা ও সাহিত্যিক সমাজের অবদান: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সমাজও আন্দোলনের প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সংবাদপত্র ও পত্রিকায় আন্দোলনের বার্তা প্রচার, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সমালোচনা এবং গণসংহতি বৃদ্ধির জন্য তাদের লেখা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মকবুল আহমেদ এবং অন্যান্য সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরা আন্দোলনের মনোবল বাড়িয়েছেন। এভাবে বুদ্ধিজীবী সমাজ রাজনৈতিক সচেতনতা ও আন্দোলনের নৈতিক শক্তি প্রদান করে।
৭. ধর্মীয় ও আঞ্চলিক সংগঠনের অবদান: ভিন্ন ধর্ম ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলোও আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। মুসলিম লীগ ও বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল। ধর্মীয় সমাবেশে আন্দোলনের বার্তা প্রচার এবং স্থানীয় জনগণকে আন্দোলনে যুক্ত করা তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
৮. আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব: ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনকে কঠোরভাবে চ্যালেঞ্জ করেছিল। আন্দোলনের সময় হাজার হাজার লোক গ্রেফতার হয়, সমাবেশ নিষিদ্ধ হয়, এবং কঠোর পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবুও, আন্দোলনের জনগণভিত্তিক প্রকৃতি ব্রিটিশ প্রশাসনকে উদ্বিগ্ন করে। সামাজিকভাবে, আন্দোলন সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে জাতীয় চেতনা ও ঐক্যের বোধ জাগিয়ে তোলে। বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ আন্দোলনের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি ছিল।
আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণের প্রকৃতি: ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি ছিল জনসাধারণের তীব্র অংশগ্রহণমূলক আন্দোলন। এর কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
(ক) সর্বস্তরের অংশগ্রহণ: গ্রাম থেকে শহর, কৃষক থেকে শ্রমিক, ছাত্র থেকে ব্যবসায়ী—সব শ্রেণী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। এই সর্বস্তরের অংশগ্রহণ আন্দোলনকে শক্তিশালী করে।
(খ) স্বতঃস্ফূর্ততা: অনেক এলাকায় আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হয়। স্থানীয় জনগণ ব্রিটিশ সরকারের অফিসে হামলা, রেলপথ বন্ধ, ব্রিজ ভাঙা, ডাক-টিকিট জ্বালানো ইত্যাদির মাধ্যমে দমনমূলক নীতি প্রদর্শন করেছিল। এই স্বতঃস্ফূর্ত পদক্ষেপ आंदोलनকে আরও শক্তিশালী করে।
(গ) শান্তিপূর্ণ এবং সহিংস উভয় প্রকারের আন্দোলন: যদিও গান্ধী শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আহ্বান করেছিলেন, কিছু এলাকায় স্থানীয় জনগণ সহিংসতা দেখিয়েছে। সরকারি দফতর, ব্রিটিশ পুলিশ স্টেশন, এবং রেলপথে আক্রমণ চালানো হয়েছে। তবে বড় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল।
(ঘ) বিক্ষোভ এবং ধর্মঘট: শহরে শ্রমিক ও মধ্যবিত্তের ধর্মঘট আন্দোলনের একটি প্রধান অংশ ছিল। ফ্যাক্টরি বন্ধ, ট্রেন ও পরিবহন সেবা বন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে ব্রিটিশ প্রশাসনের কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়।
(ঙ) গণসচেতনতা সৃষ্টি: বিভিন্ন সামাজিক মিডিয়া বা সংবাদপত্রের বিকল্প হিসেবে লিফলেট, পুস্তিকা ও গণমঞ্চে বক্তব্যের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার দাবির সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়।
আন্দোলনের ফলাফল এবং প্রভাব: ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে তাত্ক্ষণিক সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন দমন করতে কারাগারে নেতাদের আটক ও গ্রেপ্তার করে। কিন্তু এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের জনগণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয় এবং স্বাধীনতার প্রতি दृঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ দেশের রাজনৈতিক চেতনা ও একতাকে दृঢ় করেছে।
উপসংহার: সংক্ষেপে বলা যায়, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক চরম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনে সব সামাজিক শ্রেণী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আন্দোলনের অংশগ্রহণের প্রকৃতি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, বহুমাত্রিক এবং কখনও কখনও সহিংস হলেও বড় পরিসরে শান্তিপূর্ণ।